ঢাকা, বুধবার, ১৪ মাঘ ১৪৩১, ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ২৮ রজব ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

চাঁদপুরে টপ সয়েল বিক্রির হিড়িক, প্রভাব পড়ছে ফসল উৎপাদনে

মুহাম্মদ মাসুদ আলম, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৭, ২০২৫
চাঁদপুরে টপ সয়েল বিক্রির হিড়িক, প্রভাব পড়ছে ফসল উৎপাদনে এক্সকাভেটর দিয়ে কেটে নেওয়া হচ্ছে ফসলি জমির টপ সয়েল

চাঁদপুর: নদী বেষ্টিত জেলা চাঁদপুরের অধিকাংশ মানুষই কৃষি ও মৎস্য আহরণের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু অবৈধভাবে ভরাট ও অপরিকল্পিতভাবে স্থাপনা নির্মাণ করায় কমে যাচ্ছে কৃষি জমির পরিমাণ।

এর ওপর অধিকাংশ বসতি পাকা হওয়ার কারণে বেড়েছে ইটের চাহিদা।  

যার ফলে বছরের এ সময়টাতে ইটভাটায় ব্যবহারের জন্য অবাধে কাটা হচ্ছে ফসলি জমির ওপরের অংশ (টপ সয়েল)। মাটির এ অংশই সবচেয়ে উর্বর। এতে খাদ্য উৎপাদন হুমকির মুখে পড়েছে। জমি উর্বরতা হারাচ্ছে, মতামত কৃষি বিভাগের।  

এদিকে নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও এসব বন্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে দাবি প্রশাসনের।  

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলার আট উপজেলায় ৯৮ হাজার ২৬৩ হেক্টর জমিতে কম-বেশি ধানসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদন হয়। তবে এসব ফসলি জমিতেই গড়ে উঠেছে শতাধিক ইটভাটা। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের তথ্যমতে প্রায় অর্ধশত ইটভাটা অবৈধ। আর বৈধ এবং অবৈধ মিলিয়ে সবগুলোতেই ইট তৈরির জন্য কাটা হচ্ছে কৃষি জমির মাটির ওপরের স্তর।

জেলার ফরিদগঞ্জ, হাজীগঞ্জ ও শাহরাস্তি উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, বিগত সময়ে অনুর্বর ও অনাবাদি জমির মাটি কেটে ইটভাটায় ব্যবহার হলেও এখন গোপনে এবং প্রকাশ্যে কৃষি জমির মাটি কাটা হচ্ছে। এসব উপজেলায় মাটি কাটার কাজে জড়িয়ে পড়েছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। তারাই বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে ভাটা মালিকদের সঙ্গে মিলে ফসলি জমির টপ সয়েল উজার করছেন।

শাহরাস্তি উপজেলার চিকুটিয়া ব্রিজ সংলগ্ন ফসলি মাঠের সেচ ম্যানেজার মো. আকবর জানান, তাদের মাঠের কিছু জমি উঁচু-নিচু। যে কারণে গত দুই বছর ফসলি জমির মাটি কাটা হচ্ছে। জমির ওপরের অংশের মাটি কাটা অবৈধ জেনেও কেন কাটা হচ্ছে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভাটা মালিকদের সঙ্গে চুক্তি এবং এই কাজ বিনিয়োগ হওয়ার কারণে মাটি কাটা হচ্ছে। তবে আগামী বছর থেকে আর কাটবেন না বলে তিনি জানান।


ফরিদগঞ্জ উপজেলার বালিথুবা পশ্চিম ইউনিয়নের মানিকরাজ এলাকার মেসার্স মানিক রাজ ব্রিক্সের পরিচালক মিরন খান বলেন, ফসলি জমির মাটি কেটে ইট তৈরির কাজে লাগানোর বৈধতা নেই জানি। কিন্তু ইট তৈরির জন্য মাটি পাব কোথায়? এ কারণে বাধ্য হয়ে মাটি কাটা হচ্ছে।

এসব এলাকার কৃষকরা বলছেন, আবাদি কৃষি জমির মাটি কাটায় জমির উর্বরতা যেমন হারাচ্ছে, তেমনি খাদ্য উৎপাদন হুমকির মুখে পড়ছে। মাটি ইটভাটায় নিতে পরিবহনের জন্য রাস্তা তৈরি করতে গিয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে আরও কৃষি জমি। একই সঙ্গে অনেকে এসব জমির মাটি সংঘবদ্ধ চক্রের কাছ থেকে কিনে জমি ভরাট করে বসতবাড়ি তৈরি করছে।

এদিকে সদর উপজেলার রামপুর ইউনিয়নের মনিহার গ্রামের হাজী সাহেবের বাড়ির সামনে ওই বাড়ির হাবিবুর রহমান ও তার ছোট ভাই মিলন প্রায় ১০ একর জমির মাটি কেটে তৈরি করছেন দীঘি। দীঘির চার পাশের বাঁধ এবং অন্য জমি ভরাট করে বসতির জন্য তৈরি করা হচ্ছে। জেলা প্রশাসনের অনুমতি না নিয়ে পাশের জমির মালিকদের ক্ষতির সম্মুখীন করা হচ্ছে বলে ওইসব জমির মালিকদের মধ্যে আনোয়ার উল্যাহ, আবিদ আলি ও মো. শাহাজালাল প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন।

অভিযুক্ত হাবিবুর রহমান বলেন, এখানে মাদরাসা হবে এবং মসজিদ পরিচালনার জন্য এ দীঘি কাটা হচ্ছে। আমরা মনে করি, কারো ফসলের ক্ষতি হবে না। তবে আমাদের জমি শ্রেণি যেহেতু নাল, এটি দীঘি করার আগে প্রশাসনের অনুমোদন নেওয়া প্রয়োজন ছিল।

চাঁদপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, অপরিকল্পিতভাবে কৃষি জমির উর্বর মাটি কেটে নেওয়া হলে এটি আগের অবস্থায় ফিরতে এবং উৎপাদনযোগ্য হতে সময় লাগে প্রায় ১৫-২০ বছর। তাও একেবারে আগের মতো উর্বর হয় না। জমির ওপরের ছয় ইঞ্চির মধ্যেই থাকে বেশি উর্বরতা। কাটা হচ্ছে আরও অনেক বেশি গভীর করে। কৃষি জমিগুলো রক্ষায় আমাদের মাটি কাটার জন্য যে আইন রয়েছে, তা বাস্তবায়নে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে।

শাহরাস্তি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ইয়াসির আরাফাত বলেন, কৃষি জমির ওপরের অংশের মাটি কাটা হচ্ছে এমন তথ্য পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়। প্রশাসনিক নানা কাজের মধ্যেও বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। এমন অভিযান নিয়মিত করা হবে।  

চাঁদপুর সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আল-ইমরান খান বলেন, জমি ভরাট করা যাবে আবার প্রয়োজনে পুকুর কিংবা দীঘিও করা যাবে। তবে ওই ব্যক্তিকে তার জমির শ্রেণি পরিবর্তন করতে হলে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের (ডিসি) কাছে আবেদন করতে হবে। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত হবে এবং তারপর শ্রেণি পরিবর্তনের বিষয়টি জনহিতকর হলে আবেদন মঞ্জুর হবে। এ ধরনের শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য একাধিকবার তদন্ত করারও প্রয়োজন হয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৭, ২০২৫
এসআই
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।