ঢাকা, শনিবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

বৈচিত্র্যময় খাদিমনগর জাতীয় উদ্যান

সাব্বির আহমদ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৫০ ঘণ্টা, মার্চ ২৯, ২০১৩
বৈচিত্র্যময় খাদিমনগর জাতীয় উদ্যান

সিলেট: দু’পাশে ঝিঁঝি পোকার অনবরত ডাকাডাকি। বিরল পাখির প্রণয়সঙ্গীত আর অচেনা পাখ-পাখালির শব্দে মুখর গহীন জঙ্গল।



পাহাড় ভেদ করে জঙ্গলে রয়েছে অপরূপ মায়াবী পরিবেশ। বনের দু’দিকে চলে গেছে দুটি পথ। এ পথ দুটি ধরে দুই ঘণ্টা ও এক ঘণ্টার দুটি ট্রেইলে পর্যটক হারিয়ে যেতে পারেন বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যে ভরা সিলেটের খাদিমনগর জাতীয় উদ্যানে। কিন্তু দেশেরতো বটেই এমনকি খোদ সিলেটবাসীদেরও অনেকেরই জানা নেই এই উদ্যানের কথা!

একই সঙ্গে চা-বাগান ও গহীন জঙ্গলের প্রাকৃতিক নিস্তব্ধতা, ঝরণাধারা, সব আছে এই উদ্যানে। দেশে বিরল প্রজাতির নানা জীবজন্তুর আশ্রয়স্থল এই উদ্যানের আয়তন ৬৭৮.৮০ হেক্টর (১৬৭৬.৭৩ একর)।

সিলেট শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে সিলেট সদর উপজেলার খাদিমনগর ইউনিয়ন ও গোয়াইনঘাট উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নে অবস্থিত।

খাদিমনগর জাতীয় উদ্যানের পূর্বে ছড়াগাং চা বাগান, জালালাবাদ সেনানিবাস এবং হবিনগর চা বাগান, পশ্চিমে বুরজান চা বাগান, কালাগুল চা বাগান, উত্তরে গুলনী চা বাগান এবং দক্ষিণে খাদিম চা বাগান।

সিলেটের পূর্বদিকে জাফলং যাওয়ার পথে নগরী থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে বনের অবস্থান। সিলেট বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন সিলেট উত্তর রেঞ্জ-১ এবং খাদিমনগর বন বীটের আওতাভুক্ত।

বর্ষাকালে ঝোপঝাড় ও বনের গাছগাছালি নিবিড় হওয়ায় সূর্যের আলো তেমন পৌঁছায় না। স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে ঝিঁঝিঁ ডাকা অন্ধকারাচ্ছন্ন পথে হাটতে অনেকেরই হয়ত গা ছমছম করে উঠবে।

এ বনের ঝোপঝাড়, লতাগুল্ম, ফুল-ফল বৈচিত্র্যপূর্ণ। পৃথিবীতে প্রাগৈতিহাসিক যুগের উদ্ভিদের মধ্যে ‘ট্রি’ ফার্ন অন্যতম। এখানে যেমন দেখা যাবে ৩০ ফুট উঁচু শতবর্ষী ‘ট্রি’ ফার্ন তেমনি বুনো বেতগাছে থোকা থোকা ফলের সমারোহ দেখতে দেখতে চোখ জুড়িয়ে যাবে। এছাড়া কদম, বেলিসহ অসংখ্য নাম না-জানা বুনো ফুলের সৌন্দর্য ও গন্ধে মোহিত হতে হবে। কিন্তু এ সৌন্দর্যকে ক্যামেরার ফ্রেমে ধরে রাখকে বেশ বেগ পেতে হবে। কেননা ছবি তোলার মতো আলোর পর্যাপ্ততা নেই এখানে।

খাদিম জাতীয় উদ্যানে রয়েছে মূল্যবান বৃক্ষরাজি। গাছপালা, তরুলতা, বাঁশ-বেত পরিবেষ্টিত খাদিমনগর জাতীয় উদ্যানে জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব তাই অপরিসীম। এখানে রয়েছে ৪০-৫৫ ফুট উঁচু ও ৫-৭ ফুট ব্যাসের মূল্যবান সেগুন গাছ।

এছাড়া ঢাকি, জাম, গর্জন, চম্পা ফুল, চিকরাশি, চাপালিশ, মেহগনি, শিমুল, চন্দন, জারুল, আম, জাম, কাউ, লটকন, বন বড়ই, জাওয়া, কাইমূলা, গুল্লি, পিতরাজ, বট, আমলকি, হরিতকি, বহেড়া, মান্দা, পারুয়া, মিনজিরি, অর্জুন, একাশিয়া, বাঁশ (জাইবাশ, বেতুয়া বাঁশ, পেঁচা বাঁশ, পারুয়া বাঁশ) এবং বেত (তাল্লাবেত, জালিবেত) ইত্যাদি।

বন বিভাগ জানায়, উদ্যানে প্রায় ২১৭ প্রজাতির গাছ এবং ৮৩ প্রজাতির প্রাণী রয়েছে।

সন্তর্পণে হাটলে পেয়ে যেতে পারেন, অজগর সাপসহ বিরলপ্রজাতির মুখপোড়‍া হনুমান।

এছাড়া উদ্যানে দিনরাত বিচরণ করছে বানর, দোয়েল, ময়না, শ্যামা, কাক, কোকিল, টিয়া, কাঠ ঠোকরা, মাছরাঙ্গা, চিল, ঘুঘু, বক, টুনটুনি, চড়ুই, বুলবুলি, বনমোরগ, মথুরা, শালিক, বানর, হনুমান, শিয়াল, বনবিড়াল, বেজি, কাঠবিড়াল, ইঁদুর, খরগোশ, মেছো বাঘ, বিভিন্ন ধরনের সাপ যেমন- অজগর, দারাইশ, উলুপুড়া, চন্দ বুড়াসহ নানা বিষধর সাপ।

শুধু বন্যপ্রাণী আর জীববৈচিত্র্যই নয় খাদিমনগর জাতীয় উদ্যান এখন দেশের জীববৈচিত্র্য গবেষকদের অন্যতম শিক্ষালয়। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষক শিক্ষক-শিক্ষার্থী ছুটে আসছেন অভয়ারণ্যের ভীড়ে নানা প্রজাতির প্রাণীবৈচিত্র্যের সন্ধানে।

কিছুদিন আগে খাদিম নগর জাতীয় উদ্যানে গহীন অরণ্যে নতুন প্রজাতির ব্যাঙের সন্ধান পান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদল। নতুন প্রজাতির ব্যাঙটির বৈজ্ঞানিক নাম Raorchestes parvulus.  

বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক গাজী আসমত ও একই বিভাগের শিক্ষার্থী সাজিদ আলী হাওলাদার এটি শনাক্ত করেন।

তবে তারা জানান, এর আগে এ প্রজাতির ব্যাঙ বিশ্বের কয়েকটি দেশে শনাক্ত হলেও বাংলাদেশে পাওয়া গেল এই প্রথম। এর আগে বাংলাদেশে ৩৭ প্রজাতির ব্যাঙের রেকর্ড রয়েছে। এখন এটিসহ ব্যাঙের প্রজাতির সংখ্যা হলো ৩৮।

তবে ব্যাঙটির প্রথম সন্ধান পান শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ৪র্থ বর্ষের ছাত্র অনিমেষ ঘোষ। ২০১১ সালে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি ব্যাঙটির খোঁজ পান।

বাংলানিউজকে তিনি জানান, খাদিম উদ্যানে ব্যঙ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে প্রায় ১৩ প্রজাতির ব্যাঙ পাওয়া গেছে।   এর মধ্যে একটি প্রজাতি রয়েছে যে ব্যাঙ বাংলাদেশের শুধু চট্টগ্রাম ও সিলেটে দেখতে পাওয়া যায়।

তিনি বলেন, ‘‘নতুন প্রজাতির ব্যঙটি মায়ানমার, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম এবং থাইল্যান্ডে দেখতে পাওয়া যায়।

সরকারিভাবে বিশাল এ বনভূমিকে ২০০৬ সালে ‘খাদিম নগর জাতীয় উদ্যান’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সিলেটের বনবিভাগ এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে। রেকর্ডপত্রে দেখা যায় ১৯৫১-৫২ সাল থেকেই এখানে বনের অস্তিত্ব রয়েছে।

১৯৫৭ সালে এই বনকে রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষণা করা হয়েছিল। বিশেষজ্ঞদের সমীক্ষা অনুযায়ী উষ্ণমণ্ডলীয় চিরসবুজ এই বন দুর্লভ প্রজাতির বৃক্ষ, লতাগুল্ম, বন্য প্রাণী ও পাখিদের অভয়াশ্রম।

বাংলাদেশ সময়: ১১৪০ ঘণ্টা, মার্চ ২৯, ২০১৩
এসএ/সম্পাদনা: মীর সানজিদা আলম/ আবুল কালাম আজাদ, নিউজরুম এডিটর/ আরআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।