বিশ্বে জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি আবিষ্কার, উদ্ভাবন ও প্রযুক্তিগত বিকাশ ব্যাপকতা লাভ করছে। মানুষের প্রয়োজনের তাগিদেই এসবের বিকাশ ঘটছে তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, একজন আমেরিকান প্রতিদিন গড় ১০১ কিলোগ্রাম বর্জ্য উৎপাদনের জন্য দায়ী। শিল্পোন্নত অন্য দেশগুলির অধিবাসীরাও অধিক পরিমাণ বর্জ্য উৎপাদনের জন্য দায়ী। কারণ তারা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি জিনিসপত্র ব্যবহার করে। সেই সঙ্গে বিশ্বব্যাপী নগরায়ণও দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। ফলে বর্জ্য দূষণও বাড়ছে মাত্রাতিরিক্তভাবে।
বাংলাদেশে বর্জ্য দূষণের অন্যতম কারণ এর ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি। উন্নত দেশগুলো যে ত্রুটিহীনভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করছে তা নয়। তবে শিল্পোন্নত দেশগুলো বর্জ্যকে পুনরায় ব্যবহার করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে। বাংলাদেশের কলকারখানার যাবতীয় বর্জ্য খাল-বিল-নদ-নদী এমনকি খোলা আকাশের নীচে ফেলে রাখা হয়। নগরবাসীর ময়লা আবর্জনাগুলো রাস্তার পাশে যেখানে সেখানে ফেলে রাখা হয়। গ্রামাঞ্চলে এই দৃশ্য দেখা না গেলেও শহরাঞ্চলে চোখে পড়ে অহরহ। এই বিষাক্ত বর্জ্য আমাদের পরিবেশকে বিপন্ন করে তোলে।
ঢাকাসহ বিভিন্ন মহানগরীর ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করার দায়িত্ব করপোরেশনের। কিন্তু বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সিটি করপোরেশন ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। উন্নত দেশের শরহরগুলিতে সাধারণত মানুষের ঘুম ভাঙার আগেই নগরীর ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করা হয়। মানুষ ঘুম থেকে জেগে আর ময়লা আবর্জনা দেখতে পায় না। কিন্তু বাংলাদেশে তার উল্টো। নগরীর বড় বড় রাস্তার পাশে দিনের পর দিন ময়লা আবর্জনা পড়ে থাকতে দেখা যায়। অনেক সময় দেখা যায় দিনে দুপুরে ময়লা আবর্জনা পরিচ্ছন্নতা অভিযান চলছে। শহরের ব্যস্ততম রাস্তা দিয়ে ময়লা আবর্জনা বহনকারী গাড়িটি গন্ধ ছড়িয়ে ছুটে যাচ্ছে। আবার ময়লা আবর্জনা ফেলারও কোনো সুব্যবস্থা নেই।
শহরের এক পাশেই খোলা আকাশের নিচে ময়লাগুলো স্তূপাকারে রেখে দেয়া হয়। ফলে আশপাশে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর জন্য এলাকাটি বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ে। শুধু ঢাকা মহানগরীতে প্রতদিন প্রায় চার হাজার টন বর্জ্যের স্তুপ জমে। এর মধ্যে ৪০ শতাংশ বর্জ্য সিটি করপোরেশন আহরণ করে।
তবে তাও অস্বাস্থ্যকরভাবে পরিবহন করা হয় এবং অনিরাপদভাবে জমা রাখা হয়। এতে তার আশপাশের পরিবেশ পুরোপুরি দুর্গন্ধময় হয়ে পড়ে। তাছাড়া নগরীর সর্বত্র জমে থাকা বর্জ্য নগরীর পরিবেশকে আরো দুর্গন্ধময় করে তুলছে। যদিও মহানগরীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সার্বিক দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। অন্যান্য কাজের চেয়ে এই কাজটির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া অত্যাবশ্যক। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে- সিটি করপোরেশন এই দিকটির প্রতি কমই নজর দেয়।
তাছাড়া এ বিষয়ে নগরবাসীও তেমন সচেতন নয়। তারা সিটি করপোরেশন নির্ধারিত স্থানে ময়লা আবর্জনা না ফেলে যেখানে সেখানে ফেলে রাখে। আবার অনেক সময় দেখা যায়, ময়লা ফেলার কন্টেইনারে না ফেলে তার আশপাশে ফেলে রাখা হয়। এর কারণে ময়লা আহরণ করা তাদের কষ্টসাধ্য হয়। এ বিষয়টির প্রতি সর্বমহলের সচেতনতা ছাড়া বর্জ্য ব্যবস্থাপায় শৃংখলা আসবে না।
বড় বড় শিল্প কলকারখানা, মাছ কোম্পানি ও ট্যানারির বর্জ্য নদী, খাল ও বিলে ফেলা হয়। এই বিষাক্ত বর্জ্য নদী-নালার পানিকে দূষিত করে। এতে নদী-নালার মাছের যেমন মড়ক দেখা দেয়, তেমনি নদী-নালার পানি পান করে মানুষ নানা রকম রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। বর্জ্য দেশের সার্বিক পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। খুলনার ভৈরব ও রূপসার দুই তীরে গড়ে ওঠা মাছ কোম্পানিসহ বিভিন্ন কলকারখানার বর্জ্য নদীতে ফেলা হচ্ছে। এতে ভৈরবও রূপসার পানি দূষিত হচ্ছে।
এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চট্টগ্রাম মহানগরীতে কোনো পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকায় প্রতিদিন গড়ে এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৫০০ টন কঠিন ও তরল বিষাক্ত বর্জ্য সরসরি কর্ণফুলী নদীতে গিয়ে পড়ছে। এতে নদীর পানি বিষাক্ত হয়ে পড়ায় মৎস্য ও জলজ প্রাণীর অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন। এ কারণে নগরবাসীর সুপেয় পানির প্রধান উৎস সারফসেওয়াটার বা ভূ-উপরিভাগের পানি ব্যবহারের সুযোগ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
অপর এক সমীক্ষা রিপোর্টে বলা হয়, সমুদ্র ও উকপূলীয় এলাকা, শিল্পাঞ্চল ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে পরিবেশের দূষণমাত্রা আশংকাজনক হারে বাড়ছে। চট্টগ্রাম বন্দরে বছরে প্রায় এক হাজার ২০০টি মালবাহী জাহাজ ও ৪০/৫০টি তেলবাহী জাহাজ চলাচল করে। এছাড়া হাজারেরও বেশি লঞ্চ, ট্রলার ও ইঞ্জিন চালিত নৌকা চলাচল করে। এসব জাহাজ, লঞ্চ ও ট্রলার থেকে বিপুল পরিমাণ তেল বঙ্গোপসাগরে পড়ে। সমুদ্র উপকূলীয় ভাটিয়ারি ফৌজদারহাটে প্রায় অর্ধশত শিপব্রেকিং ইয়ার্ড রয়েছে। এ ইয়ার্ডগুলোতে যে জাহাজ কাটা হয় সেসবের তেল, লুব্রিকেন্ট, মবিল ইত্যাদি সাগরে ফেলা হয়। বিদেশি জাহাজ অনেক সময় গোপনে এসে বঙ্গোপসাগর এলাকায় তাদের বর্জ্য ফেলে যায়। এতে সাগরের মৎস্য সম্পদের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
সীতাকুন্ডে পরিবেশ দূষণ মারাত্মক পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। বিভিন্ন শিল্পকারখানা, যানবাহন, ইটের ভাটা থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া ও বর্জ্য পদার্থ পরিবেশকে বিষিয়ে তুলছে। বিশেষ করে জাহাজ ভাঙা কারখানার বর্জ্য নিক্ষেপে সমুদ্র উপকূল মৎস্যশূন্য হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। এছাড়া মলমূত্র ত্যাগ এবং জবাই করা গরু-ছাগলের বর্জ্যেও পরিবেশ দূষণ হচ্ছে।
পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যায, রূপগঞ্জের তারাবো এলাকার ঢাকা বোন অ্যান্ড ফার্টিলাইস ইন্ডাস্ট্রিজ ও খুলনার হাড় কোম্পানির বিষাক্ত গ্যাসে আশপাশের পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। মিলের বর্জ্য গ্যাস, মরা পশুর মাংস এবং হাড় সিদ্ধ পানি সরাসরি ফেলা হচ্ছে শীতলক্ষ্য নদীতে। এতে শীতলক্ষ্যার পানি পুরোপুরি দূষিত হয়ে পড়েছে।
অপরদিকে খুলনা হাড় কোম্পানির বর্জ্য ফেলা হচ্ছে রূপসায়। এতে দূষিত হচ্ছে উভয় নদীর পানি।
কাপ্তাই থানার চন্দ্রঘোনায় কর্ণফুলি পেপার মিলের বর্জ্য কর্ণফুলি নদীতে ফেলায় নদীর পানি দূষিত হচ্ছে। ওই এলাকায় কর্ণফুলি নদীর সঙ্গে সংযুক্ত পেপার মিলের প্রধান নর্দমার পিএইচ মানমাত্রা গ্রহণযোগ্য পিএইচ মানমাত্রার চেয়ে ১ দশমিক ৯ মাত্রা বেশি নিরূপিত হয়েছে। যা অতি ক্ষারযুক্ত বলে পরিবেশবিদরা জানিয়েছেন।
এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় কি?
উন্নত দেশগুলোর মতো বর্জ্যকে পুনঃব্যবহারযোগ্য করে তোলা অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়েছে। বর্জ্য থেকে জৈব সার প্রস্তুতের মাধ্যমে এটি দেশের উৎপাদনশীল কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে।
জানা যায়, বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বর্জ্যের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পারলে প্রতিদিন ২৪০ টন জৈব সার তৈরি করা সম্ভব হবে। এর ফলে বছরে জাতীয় তহবিলের ৩৫ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। তাছাড়া কর্মসংস্থান হবে প্রায় ১০ হাজার লোকের।
আমরা জানি, জৈব সার তৈরির প্রক্রিয়া ব্যয়বহুল নয়। এজন্য বড় ধরনের শিল্পও স্থাপন করতে হয় না। স্থানীয়ভাবে যন্ত্রপাতি তৈরি করে জৈব সার উৎপাদন করা যায়। জৈব সার উৎপাদনের উদ্যোগ নিলে বিদেশ থেকে সারের আমদানিও কমবে। ক্ষতিকর রাসায়নিক সারের বিকল্প হিসেবে জমিতে জৈব সার ব্যবহার করলে জমির ফলন যেমন বাড়বে তেমনি আবার পরিবেশেরও কোনো ক্ষতি হবে না।
বর্তমানে ময়লা আবর্জনার ব্যবস্থাপনা সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষকে মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন করে তুলেছে। জনসংখ্যার বৃদ্ধি, দ্রুত নগরায়ন ইত্যাদি কারণে আবর্জনার পরিমাণ ক্রমাগতই বাড়ছে। এসব ময়লা রাস্তার পাশে খোলা জায়গায় পড়ে থাকছে বলে জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি ডেকে আনছে। সিটি করপোরেশনের উচিত রাস্তার পাশে ডাস্টবিনগুলো সরিয়ে ফেলা এবং নতুন কর্মপন্থা প্রণয়ন করা। যাতে ময়লা-আবর্জনা ব্যবস্থাপনার জন্য এনজিও এবং এলাকাভিত্তিক সংগঠনগুলো অংশ নিতে পারে।
পৃথিবীর বিভিন্ন শহরের ময়লা আবর্জনা সংগ্রহ, নিষ্কাশন, পুনর্চক্রায়নের মাধ্যমে কাজে লাগানো হয়ে থাকে। আমাদের দেশে ও এ বর্জ্যকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন জৈব সারসহ বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি সম্ভব।
এ বিষয়ে জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করার লক্ষ্যে সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন, নাটক প্রভৃতির মাধ্যমে প্রচার করা যেতে পারে।
বর্জ্যের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে, বাড়ির আশপাশ পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি করা যায়। এ কাজে স্কুলের শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করা যায়। তবে সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে বর্জ্য থেকে জৈব সার তৈরির উদ্যোগটিও নিতে হবে। এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে বিপুল পরিমাণ বর্জ্য দেশের উৎপাদনশীল খাতে ব্যয় হবে।
ড. ফোরকান আলী: লেখক গবেষক ও সাবেক অধ্যক্ষ
বাংলাদেশ সময়: ১১৩৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৫, ২০১৩
এএ/জিসিপি- [email protected]