ঢাকা, শনিবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

উপকূল থেকে উপকূলে

সুদীর্ঘ ফেরি রুট, ভরসা জোয়ার-ভাটা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫৫৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১১, ২০১৩
সুদীর্ঘ ফেরি রুট, ভরসা জোয়ার-ভাটা

উপকূল ঘুরে (ভোলা ও লক্ষ্মীপুর): জোয়ারের পানি নেমে যাওয়ার অপেক্ষায় সবাই। পানির কারণে ফেরি থেকে তীরে উঠতে পারছে না বাস।

তাই, ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা ধরে অপেক্ষমান বাস-ট্রাকও উঠতে পারে না ফেরিতে। বিলম্বে ছাড়ে ফেরি। গন্তব্যে পৌঁছাতেও হয় দেরি। ফলে, যাত্রীদের ভোগান্তি পৌঁছায় চরমে।

ভোলার ইলিশা আর লক্ষ্মীপুরের মজুচৌধুরী ফেরিঘাটে এমন দৃশ্য নিত্যদিনের। জোয়ার-ভাটা আর বহুমুখী প্রাকৃতিক দুর্যোগের ওপর ভর করে চলছে দেশের সবচেয়ে বড় এ ফেরি রুট। একপাড়ে ভোলা সদরের ইলিশা।

আর অন্যপাড়ে লক্ষ্মীপুরের রামগতির মজুচৌধুরী ঘাট। স্বাভাবিক সময়ে মাঝখানে ভয়াল মেঘনা নদীপথে ফেরি রুটের দূরত্ব প্রায় ২৬ কিলোমিটার। জোয়ার-ভাটার প্রভাবে ঘুরে যেতে হলে এ পথের দূরত্ব বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ কিলোমিটারের বেশি।

সকাল সাতটার মধ্যে ফেরিঘাটের ঘুম ভাঙে। দোকানপাট খুলে সারাদিনের বেচাকেনার জন্য প্রস্তুতি নেন ব্যবসায়ীরা। বেলা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোলার বিভিন্ন রুট থেকে ঘাটে ভিড়তে থাকে বাস-ট্রাক ছাড়াও নানা শ্রেণীর যানবাহন।

মাছ কিংবা অন্য পণ্যবোঝাই করে দাঁড়িয়ে থাকে ট্রাক। যাত্রীবাহী বাসগুলোর যাত্রীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা অলস সময় কাটিয়ে দেন। সবার দৃষ্টি ফেরির দিকে। ফেরি ঘাটে না এলে দূরের মেঘনার দিগন্তে চোখ থাকে তাদের। আর ফেরিঘাটে থাকলে অপেক্ষা কখন ছাড়ার সময় হবে!

সরেজমিন ইলিশা ও মজুচৌধুরী ফেরিঘাটে যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এ পথে স্বাভাবিক নিয়ম বলতে কিছুই নেই। স্বাভাবিক নিয়মটাই এখন অস্বাভাবিক। নিয়ম অনুযায়ী ভোলা থেকে চট্টগ্রাম যেতে ৮ ঘণ্টা লাগার কথা থাকলেও ফেরির এ সংকটজনক অবস্থার কারণে সময় লাগে প্রায় দ্বিগুণ।

বেসরকারি চাকরিজীবী মনিরুল ইসলাম ভোলা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে আটকা পড়েছিলেন ভোলার ইলিশা ফেরিঘাটে। বিআরটিসি বাসে ভোলা থেকে যাত্রা শুরু করেছেন সকাল ৯টায়। তখন থেকেই ফেরিঘাটে ফেরির জন্য অপেক্ষা। একই বাসে যাচ্ছিলেন বোরহানউদ্দিন, জামালউদ্দিন ছাড়াও অনেকে। সবারই একই দুর্ভোগ।

সরেজমিন দেখা গেল, দুপুরে ফেরি ‘কিষাণী’ শুধু ইলিশা ঘাটে ভিড়েছে। ঘাটের র‌্যাম্প (টার্মিনাল থেকে রাস্তায় ওঠার পথ) জোয়ারের পানিতে ডুবে থাকায় বাস কিনারে উঠতে পারছে না। একটি বাস পানি অতিক্রম করতে গিয়ে বিকল হয়ে যায়। যাত্রীরা কোনোভাবে পানি পেরিয়ে কিংবা নৌকায় কিনারে উঠতে পেরেছেন। বাসের অপেক্ষা না করে অনেকেই চলে গেছেন অন্য বাসে। কিন্তু, পারাপারের অপেক্ষায় থাকা যাত্রীরা একেবারেই উপায়হীন।

ভোলার বিভিন্ন এলাকা থেকে চট্টগ্রামগামী যাত্রীবাহী বাস, মালবাহী ট্রাক ও পিকআপ মিলে প্রতিদিন অর্ধশতাধিক যানবাহন চলাচল করে এ পথে। কিছু যাত্রী লঞ্চ ও ট্রলারে পারাপারের জন্য এ ঘাটে আসে। সব মিলিয়ে দুই সহস্রাধিক লোকের ভরসা এ ফেরিঘাট।

প্রসঙ্গত, ২০০৮ সালে দ্বীপজেলা ভোলাবাসীর দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষিত ভোলার ইলিশা থেকে লক্ষ্মীপুরের রামগতির মজুচৌধুরী ঘাট রুটে ফেরি চালু হয়। এর অন্যতম লক্ষ্য ছিল চট্টগ্রাম ছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে ভোলার সড়ক যোগাযোগ নিশ্চিত করা। কিন্তু পাঁচ বছর পরেও তা পুরোপুরি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। ফেরি সংকট থেকে শুরু করে নাব্যতা নিয়ে আছে অন্তহীন সমস্যা।

স্থানীয় বাসিন্দারা বাংলানিউজকে জানান, জোয়ারের পানি প্রতি ২৪ ঘণ্টায় দুবার এ ফেরিঘাটের যাত্রীদের দুর্ভোগে ফেলে। দিনের জোয়ারে ভোগান্তির মাত্রা বেশি। জোয়ারের পানি উঠলে কমপক্ষে তিন ঘণ্টা অচল হয়ে পড়ে ঘাট। বর্ষাকাল ও দুর্যোগপূর্ণ সময়ে এ সমস্যা আরও প্রকট হয়।

ফেরি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্বাভাবিক সময়ে ইলিশা ঘাট থেকে মজুচৌধুরী ঘাটে পৌঁছাতে সময় লাগে ২ ঘণ্টা ৫ মিনিট। আর মজুচৌধুরী ঘাট থেকে ইলিশা আসতে সময় লাগে ৩ ঘণ্টা ৫৫ মিনিট। দুর্যোগপূর্ণ সময়ে এ সময় প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে অনেক সময় ফেরি মাঝপথেই থামিয়ে রাখতে হয়।

বিআইডাব্লিউটিসি’র অধীনে পরিচালিত ফেরি কিষাণী’র ইনল্যান্ড মাস্টার অফিসার মফিজ উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, ‘এটি দেশের সবচেয়ে দীর্ঘ ও ঝুঁকিপূর্ণ ফেরি চলাচলের রুট। আরিচা ৬ কিলোমিটার এবং মাওয়া ১২ কিলোমিটার ফেরির পথ। আর এ ফেরিকে পাড়ি দিতে হয় দীর্ঘ ২৬ কিলোমিটার পথ। এ পথে বর্তমানে মাত্র দুটি ফেরি চলাচল করছে। ঘাটের সমস্যা ঠিক করা হলে যাত্রীদের দুর্ভোগ কমে আসবে। ’

ফেরি চলাচলকারী কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য মতে, ইলিশা ঘাট সংলগ্ন রামদাসপুর ট্যাক থেকে বিরবিরি বয়া অবধি পলি পড়েছে। ইলিশা ঘাটের আশপাশেও নাব্যতা আছে। জোয়ার কিংবা ভাটা কোনো সময়ই এ পথে ফেরি চলাচল করতে পারে না।

ফেরিকে দীর্ঘ পথ ঘুরে যেতে হয়। অন্যদিকে, লক্ষ্মীপুর মজুচৌধুরী ঘাটে ফেরি ঢুকতে রহমত আলী খালেও আছে নাব্যতা সংকট। পূর্ণাঙ্গ জোয়ার ছাড়া ওই পথে ফেরি ঢুকতে কিংবা বের হতে পারে না। এ বিষয়গুলো ফেরি চলাচলে অন্যতম সমস্যা বলে বাংলানিউজকে জানায় ফেরি কর্তৃপক্ষ।

সংকট নিরসনে বিআইডাব্লিউটিসি কর্তৃপক্ষের কাছেও নেই সদুত্তর। বাংলানিউজের প্রশ্নের জবাবে বিআইডাব্লিউটিসি ভোলা-লক্ষ্মীপুর ফেরি সার্ভিসের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার শিহাব উদ্দিন বলেন, ‘ফেরি সংকট, নাব্যতা সংকট আর জোয়ারের সময় ঘাট ডুবে যাওয়ার কথা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়। কিন্তু, কোনো পদক্ষেপের কথা জানা নেই। ’

ভোলা-লক্ষ্মীপুরের দুপাড়ের যাত্রীদের একই সমস্যা ঝুলে আছে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। বহু দাবি, বহু আবেদন নিবেদন, তবুও সংকট কাটছে না। সংকট নিয়েই দেশের দীর্ঘতম ইলিশা-মজুচৌধুরী ফেরিঘাটের ঘুম ভাঙে। দিনের আলোয় ফিরে আসে কর্মচঞ্চলতা, রাতে আবার নীরব-নিঝুম হয়ে পড়ে মেঘনাপাড়ের এ দুটি ঘাট।

বাংলাদেশ সময়: ০৫২৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১১, ২০১৩
আরআইএম/এসএইচ/এবি/জিসিপি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।