স্বার্থহীন ভালোবাসার কথা আসলেই মনে পড়ে দেবদাস-পাবর্তী, শিরি-ফরহাদ, লায়লী-মজনু, আনারকলি-সেলিম এর ভালোবাসার জন্য আত্মত্যাগ মহিমার স্মৃতিচারণ।
কিন্তু আমাদের বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো ডাহুক-ডাহুকীর স্বার্থহীন ভালোবাসার গল্প শুনলে নিশ্চয়ই অবাক হতে হয়।
তবু স্বার্থক তাদের জীবন। স্বার্থক তাদের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, তাদের ভালোবাসা অসীম, চিরন্তন। বিদ্যাপতি, চন্ডীদাস, জীবনানন্দ, ফররুখ, আল মাহমুদের কাব্যের অন্যতম অলংকার এ পাখি। কখনো রূপে, কখনো প্রতীকে, না বলা অনেক কথা, কথা হয়ে উঠেছে তাদের কবিতায় ডাহুক-ডাহুকীর ডাকে। পাখিটি খুব ভীরু প্রকৃতির।
জলাভুমির আশেপাশের ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে থাকা ডাহুক আকৃতিতে মাঝারি। লেজ ছোট, পা লম্বা। এরা ৫২-৫৮ সে. মি. র্পযন্ত লম্বা হয়। বেশ লম্বা পায়ের আঙ্গুলও। মানুষের আওয়াজ পেলেই লুকিয়ে পড়া এই পাখির অন্যতম স্বভাব। ডাহুকের পিঠের রং ধূসর থেকে খয়েরি-কালো হয়। মাথা ও বুক সাদা। লেজের নিচের অংশে লালচে আভা। ঠোঁট হলুদ, ঠোঁটের উপরে আছে লাল রঙ্গের একটি ছোট দাগ।
ডাহুক খুব সুন্দর একটি পাখি। এরা বর্ণালি পাখি, এদের পুরো শরীরে পালকের রং নীল। জল এদের প্রধান আশ্রয়। পুকুর, খাল, জলাভুমি, বিল, নদীর গোপন জায়গা এদের খুব প্রিয়। পায়ের নখগুলো লম্বা লম্বা, ফলে পদ্ম ও শাপলা পাতায় দিব্যি দাঁড়িয়ে থাকতে পারে এবং কচুরিপানার ওপর ছোটাছুটি করতে পারে। বাসা তৈরি করে মাটিতে, ঝোঁপের তলায়। জলজ উদ্ভিদের বীজ, কচুরিপানা ও কলমি ঝোপে পানির ওপর এরা খড়কুটো এবং শুকনো শ্যাওলা ও জলজ উদ্ভিদ দিয়ে গোলাকার পরিপাটি বাসা বানায়।
প্রজননকাল (জুন-সেপ্টেম্বর) আষাঢ়-শ্রাবণ মাস। এই সময় তাদের মৃত্যুর হারও বেশি। ডিম পাড়ে ৬-৭টি। ডিমের রং ফিকে হলুদ বা গোলাপি মেশানো সাদা। ডিমে তা দেয় স্ত্রী-পুরুষ উভয় মিলে। তবে মজার ব্যাপার হলো বাচ্চাদের রং হয় সবসময় কালো। উদ্ভিদের ডগা এদের প্রিয় খাবার, এছাড়া জলজ পোকা-মাকড়, শ্যাওলা।
ডাহুক অন্য পাখিদের মতো বাচ্চাদের মুখে করে খাওয়ায় না। বিশেষ করে মা ডাহুকী কখনোই এই কাজ করে না। প্রাকৃতিক নিয়মে বাচ্চাগুলো ডিম থেকে বেরিয়ে লাফিয়ে পড়ে মাটিতে। তারপর মা-বাবার সঙ্গে পিছে পিছে ঘুরে খাবার খায়।
ডাহুকের ইংরেজি নাম- Pheasant Tailer Jacana, বৈজ্ঞানিক নাম- Pheasant Tailer Jacana, গোত্র- Rallidae। ডাহুকের বৈজ্ঞানিক নামের অর্থ লাললেজী কালো পাখি (গ্রিক- amauros = কালচে, ornis = পাখি, লাতিন- phoenicurus = লাল লেজের গির্দি)।
রাতে ডাহুকের ‘কোয়াক’ ‘কোয়াক’ ডাক শুনে সহজেই একে চেনা যায়। এই ডাক পুরুষ পাখির, যা বর্ষাকালে বেশি শোনা যায়। একটানা অনেকক্ষণ ডেকে এরা শ্বাস নেয়। কিন্তু মায়াবী এই পাখিটি চোরা শিকারি আর বাসস্থানের অভাবে দিন দিন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। জলাভুমির অতিচেনা নীল ডাহুক পাখিটিও হারিয়ে যাচ্ছে।
আগে গ্রামাঞ্চলের ঝোপঝাড়, জলাশয় এবং কচুরিপানা সমৃদ্ধ পুকুরেও এদের দেখতে পাওয়া যেত। কিন্তু এখন বড় বড় বিল হাওর ছাড়া এদের দেখতে পাওয়া যায় না।
আল মাহমুদ ডাহুক নিয়ে তার কবিতায় তুলে ধরেছেন এমনভাবে-
স্মৃতির মেঘলাভাবে শেষ ডাক ডাকছে ডাহুক
অদৃশ্য আত্মার তরী কোন ঘাটে ভিড়ল কোথায়?
কবি জীবনানন্দ বলেছেন,
মালঞ্চে পুষ্পিতা লতা অবনতামুখী-
নিদাঘের রৌদ্রতাপে একা সে ডাহুকী
বিজন-তরুণ শাখে ডাকে ধীরে ধীরে,
বনচ্ছায়া-অন্তরালে তরল তিমিরে।
চন্ডীদাস তার কবিতায় লিখেছেন-
ভাদর মাসে অহোনিশি অন্ধকারে/শিখি ভেক ডাহুক করে কোলাহল।
তাত না দেখিবো যবে কাহ্নাঞ্চরি মুখ/ চিনি-তে মোর ফুট জায়িবে বুক।
ডাহুক-ডাহুকীর-এদের ডাক, কষ্ট অনেকের আশ্রয়।
আর ফররুখ আহমেদ তার বিখ্যাত কবিতা ডাহুকে তো বলেছেনই-
গুলে বকৌলির নীল আকাশ মহল/ হয়ে আসে নিসাড় নিঝুম
নিভে যায় কামনা-চেরাগ/ অবিশ্রান্ত ওঠে শুধু ডাহুকের ডাক।
কোন ডুবুরির/ অশরীরী যেন কোন প্রচ্ছন্ন পাখির
সামুগ্রিক অতলতা হতে মৃত্যু-সুগভীর ডাক উঠে আসে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪০২ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৭, ২০১৩
জেডএস
ছবি ও লেখা: শোভন দাশ বাবু
ই-মেইল: [email protected]