খোকসা (কুষ্টিয়া): কুষ্টিয়ার ৬টি উপজেলায় ফসলি জমির উপরিভাগের মাটি কেটে ইটভাটায় বিক্রি করা হচ্ছে। একশ্রেণীর দালাল ও ইটভাটার মালিক এভাবে মাটি কাটলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
একই সঙ্গে এতে মাটিতে থাকা ফসল উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য-উপাদানও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে ধানসহ অন্যান্য ফসলের উৎপাদন বহুলাংশে কমে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন কৃষি কর্মকর্তারা।
জেলার বিভিন্ন স্থানে ঘুরে দেখা গেছে, কুমারখালী, খোকসা, মিরপুর, দৌলতপুর, সদর, ভেড়ামারা উপজেলার বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি গ্রামে মাটিকাটার শ্রমিক দিয়ে কৃষিজমির উপরিভাগের উর্বর অংশ কেটে নেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে কুমারখালীর বাটিকামারা, জিলাপীতলা এলাকা থেকে প্রতিনিয়ত মাটি কেটে ইটভাটায় বিক্রি করা হচ্ছে।
কুমারখালীর বাসিন্দা রহমান মিয়া জানান, তিনি প্রতি ট্রাক্টর ৩০০ টাকা করে এক একর জমির মাটি বিক্রি করেছেন। তবে মাটি কেটে নেওয়ায় ফসলের উৎপাদন যে কমে যাবে তা তিনি জানেন না। কুমারখালী লুৎফর রহমানের ইটভাটায় এসব মাটি যাচ্ছে।
এবারও কুষ্টিয়ায় অর্ধশতাধিক অবৈধ ভাটায় ইট পোড়ানোর কাজ শুরু হয়েছে। এসব ভাটার মালিকরা স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে ভাটা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই অবৈধ ব্যারেল চিমনির ইটভাটা মালিকরা প্রত্যেকে টাকা দিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের মুখ বন্ধ করে দিয়েছে।
পরিবেশ অধিদফতরের কোনো অনুমতি ছাড়াই কুষ্টিয়া জেলায় ৪৫টির মতো অবৈধ ভাটা চলছে। দৌলতপুর উপজেলাতেই রয়েছে ২০টি ইটভাটা। বাকি ৫ উপজেলায় ২৫টি। সদর উপজেলার আলামপুর মাঠের মধ্যে কৃষিজমিতে অবৈধভাবে ভাটা তৈরি করা হয়েছে। এ ভাটার কোনো অনুমতি নেই বলে জানা গেছে।
টিনের তৈরি ব্যারেল চিমনি দিয়ে চলছে এ ভাটাটি। কৃষকদের জমির উপরিভাগ থেকে মাটি কেটে ইট প্রস্তুত চলছে। এছাড়া হরিপুরে বসতবাড়ির পাশে হাফিজ নামের এক ব্যবসায়ী ভাটা তৈরি করে তা চালিয়ে আসছে। গত কয়েক বছর ধরে এ অবৈধ ভাটায় ইট প্রস্তুত করা হচ্ছে। গত দু’বছর আগে কুষ্টিয়ার সদর ইউএনও মমতাজ বেগম অভিযান চালিয়ে ভাটাটি বন্ধ করে দিয়েছিলেন বলে জানা গেছে। তবে কিছুদিন পর আবারও উৎপাদন শুরু হয় এ ভাটায়।
এবছরও ভাটায় কাজ শুরু হয়েছে। সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুরেও চলছে অবৈধ ভাটা। গতবছর এ ভাটাটি বন্ধ করে দিলেও ফের শুরু হয়েছে কার্যক্রম। অথচ ইট পোড়ানো নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৮৯-এর ৪-এর ৩(১) ধারায় বলা হয়েছে, লাইসেন্স ব্যতীত কোনো ব্যক্তি ইটের ভাটা স্থাপন করতে পারবেন না। ইট প্রস্তুত ও ইট পোড়াতেও পারবেন না।
কুমারখালীর বাটিকামারা গ্রামে লুৎফর রহমানের (এল.আর.বি.) এবং জাফর উদ্দিনের ইটভাটায় জমির উপরিভাগের মাটি বিক্রি করা হচ্ছে। এল.আর.বি. ব্রিকফিল্ডের মালিক লুৎফর রহমান জানান, ইট প্রস্তুতের কাজে কৃষকদের কাছ থেকে প্রতি ট্রাক্টর মাটি ৪০০ ও ৫০০ টাকা করে কেনেন। এভাবে ইটভাটার কাছের এলাকার কৃষিজমি থেকে প্রতিদিন ট্রাকের পর ট্রাক মাটি কাটা হচ্ছে।
ইটভাটা মালিকরা ১২০ ফুট স্থায়ী চিমনি নির্মাণ না করে টিনের তৈরি ছোট সাইজের চিমনি দিয়ে কাজ চালিয়ে নিচ্ছে। এ ভাটা মালিকরা সংশ্লিষ্ট দফতরে কেবল মূল সংযোজন কর (ভ্যাট) জমা দিয়ে ভাটা চালু করেছে। ভাটা স্থাপনের আগে নিয়ম অনুযায়ী পরিবেশ অধিদফতর থেকে ছাড়পত্র নেওয়ার কথা থাকলেও এসব টিনের চিমনি ভাটার ক্ষেত্রে তা নেওয়া হয়নি। জনবসতির ৩ কিলোমিটারের মধ্যে ভাটা স্থাপনের ব্যাপারে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা মানা হয়নি। এসব ভাটার আশপাশেই রয়েছে বাড়ি-ঘর ও ফসলি জমি।
ইটভাটা মালিক মন্টু জানান, তারা ভ্যাট দেওয়ার পর সরকারের অনুমতি নিয়েই এসব ভাটা চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি কৃষকদের জমির মাটি কাটা ও কাঠ পোড়ানোর কথা অস্বীকার করে বলেন, তাদের ভাটায় ইট পোড়ানোর কাজে কোনো কাঠ ব্যবহার হয় না কিংবা কৃষকদের জমির মাটি কাটা হয় না ।
মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট খুলনার বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (যশোর অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত) শচীন্দ্রনাথ বিশ্বাস বলেন, জমির উপরিভাগ কেটে ফেলার কারণে উর্বরাশক্তি নষ্ট হয়ে যায়। উপরিভাগের নয় ইঞ্চি থেকে এক ফুট পর্যন্ত উদ্ভিদের খাদ্যকণা থাকে। এটা কেটে ফেলার কারণে জমিতে আবাদ করা উদ্ভিদের শেকড় পর্যাপ্ত খাদ্যকণা না পাওয়ায় ওই জমিতে ফসল খুব একটা ভালো হয় না।
পরিবেশ অধিদপ্তর খুলনার পরিচালক তরুণ কান্তি সিকদার বলেন, আবাদি জমির এক ফুট পরিমাণ উপরিভাগের মাটি কাটার ব্যাপারে সরকারি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। খুলনায় পরিবেশ আদালত গঠন না হওয়ায় আইন প্রয়োগে চরম অসুবিধা হচ্ছে। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারেন এবং আইনেও জেলা প্রশাসককে সে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসকের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা হলে তিনি জানান, ইট ভাটায় ইট প্রস্তুত কাজে উপরিভাগের মাটি কাটার ব্যাপারে কেউ কোনো অভিযোগ করেনি। অভিযোগ করলে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭০৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৫, ২০১৩
এএ/জেসিকে[email protected]