ঢাকা: স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ জেনেটিক্যালি মডিফায়েড অর্গানিজম (জিএমও) বিটি বেগুনের বীজ ছাড়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
সোমবার পরিবেশ অধিদপ্তরের অধীনে একটি বায়োসেফটি সম্পর্কিত বিশেষ কমিটির মাধ্যমে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় দেশের খাদ্য নিরাপত্তার প্রতি হুমকি সৃষ্টিকারী এ প্রজাতির বেগুনের বাণিজ্যিক ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়ার সিদ্ধান্তটি নিলো কোনো ধরনের যাচাই বাছাই না করেই।
জেনেটিক্যালি মডিফায়েড (জিএম) বেগুনের (বিটি বেগুন) চাষ ভারত ও ফিলিপাইনে নিষিদ্ধ হলেও বাংলাদেশে তা কৃষক পর্যায়ে ছাড়ার অনুমোদন চেয়ে গত জুনের মাঝামাঝি সময়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট (বারি)।
সম্প্রতি কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ও খাদ্যমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক এই বেগুন চাষের অনুমোদন দেওয়ার ব্যাপারে তাদের সম্মতির কথা জানান।
মার্কিন কোম্পানি মনসান্তো ও ভারতের মহারাষ্ট্র হাইব্রিড বীজ কোম্পানি মাহিকোর যৌথ কারিগরি সহযোগিতায় এবং ইউএসএআইডির আর্থিক সহায়তায় ২০০৫ সাল থেকে বাংলাদেশের স্থানীয় নয়টি প্রসিদ্ধ বেগুনের জাতের জিন সিকোয়েন্স পরিবর্তন করে বিটি ব্যাকটেরিয়ার জিন প্রতিস্থাপন করার প্রকল্প হাতে নেয় বারি। আর সেই উদ্যোগে ৬টি আলাদা আলাদা এলাকায় এই বেগুনের পরীক্ষামূলক চাষ হয়।
ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা আক্রমণে প্রতি বছর অনেক বেগুন নষ্ট হচ্ছে। এছাড়া পোকা দমনে কৃষক বারবার কীটনাশক ব্যবহার করছেন। তাই এ বেগুনের বাণিজ্যিক ব্যবহারের পক্ষের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিটি বেগুন কীটনাশক ছাড়া নিজে থেকেই পোকা দমনে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে। ফলে কীটনাশকের ব্যবহার ব্যাপকহারে কমে যাবে এবং কীটনাশকের ব্যবহারজনিত পরিবেশের ক্ষতি কমে আসবে।
কিন্তু বারি`র এই বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে বিটি বেগুনকে বিষাক্ত বলে উল্লেখ করছেন কৃষি ও পরিবেশসংশ্লিষ্টরা। কেবল বিষাক্তই নয়, বিটি বেগুন কৃষকের বীজ নিরাপত্তা, খাদ্যনিরাপত্তা, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্যও হুমকিস্বরূপ বলে অভিযোগ করেছেন অনেক বিজ্ঞানী।
নিয়ম অনুযায়ী, বিটি বেগুনের পরীক্ষামূলক চাষ গ্রিন হাউজের মধ্যে করার কথা থাকলেও তা চালানো হয়েছে উন্মুক্ত মাঠে। যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। একই সঙ্গে, এই গবেষণার তথ্য নিয়ে রয়েছে বেশ কিছু বিভ্রান্তি। বারি বিটি বেগুনের গবেষণা কার্যক্রম- মাঠ দিবস হয় ২০১৩’র জুনে। অন্যদিকে, ২০০৯ সালে জিএম বিটি বেগুন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন মেহেরুন্নাহার ও ডিএনআর পাল। কিন্তু মাঠ দিবস পালনের মাধ্যমেই গবেষণালব্ধ ফলাফল প্রকাশিত হয়। সুতরাং, এর আগে এই গবেষণার তথ্য প্রকাশিত হয় কীভাবে, যা বিভ্রান্তিমূলক বলে জানালেন, প্রাণীবৈচিত্র্য ও প্রতিবেশ বিষয়ক গবেষক পাভেল পার্থ।
জিএম বিটি বেগুন নিয়মিত খেলে অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কা আছে এবং ভারতীয় কোম্পানি মাহিকোর গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী বিটি বেগুন লিভার ক্ষয়সাধন এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমাতে পারে। মাহিকোর ৯০ দিন ধরে ইঁদুরের উপর পরিচালিত বিটি বেগুনের বিষক্রিয়া নিয়ে গবেষণা থেকে জানা যায়, এই জিএম বেগুন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, যকৃতের ক্ষয় সাধন করে এবং পুনরুৎপাদনের ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। তবে, আবিষ্কারক কোম্পানি দাবি করেছে, এই বেগুন স্তন্যপায়ী প্রাণীর ক্ষেত্রে নিরাপদ এবং কোনো স্বাস্থ্য ঝুঁকি নেই।
ভারতের কৃষিবিদ, পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীসহ কৃষকদের আন্দোলনের মুখে পরিবেশ মন্ত্রণালয় ২০১০ সালে এই জিএম বেগুনের বাণিজ্যিক ব্যবহার ১০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করে। গ্রিনপিসের মতো আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদী সংগঠন তার নিজস্ব গবেষণায় দাবি করেছে, এই জিএম বেগুনের চাষাবাদ পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য এবং মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হতে পারে।
এই প্রজাতির বেগুন বাজারজাতকরণ বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানায় আন্তর্জাতিক মহল। জানা গেছে, সম্প্রতি ১২জন গবেষক সম্মিলিতভাবে একটি চিঠির মাধ্যমে বিটি বেগুনের বীজ ছাড়ের সিদ্ধান্ত বাতিল করার পরামর্শ দিয়েছেন। চিঠিতে বিভিন্ন স্বাস্থ্য ঝুঁকির কথা উল্লেখ করেছেন তারা।
ক্যালিফোর্নিয়ায় অবস্থিত সাল্ক ইন্সটিটিউট ফর বায়োলজিক্যাল স্টাডিজের অধ্যাপক ডেভিড সুবার্ট স্বাক্ষরিত ওই চিঠির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন।
আরও স্বাক্ষর করেছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী কিংস কলেজ লন্ডন স্কুল অব মেডিসিনের অধ্যাপক ড. মাইকেল অ্যান্টনিও, হাঙ্গেরির গ্রাম উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের জিনমও বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সুসান বারদোচু, ভারতের ন্যাশনাল নলেজ কমিশনের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ড. পুষ্প এম ভারগাভা, জিএম খাদ্য বিশেষজ্ঞ এবং ফ্লিন্ডার্স ইউনিভার্সিটি ইন সাউথ অস্ট্রেলিয়ার অধ্যাপক ড. জুডি কার্ম্যান, ইউনিভার্সিটি অব কান্টাবারির অধ্যাপক জ্যাক এ হেনিমেন, ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসেসমেন্ট অব এগ্রিকালচারাল নলেজের কো-চেয়ার অধ্যাপক হ্যান্স আর হেরেন, সুইস ফেডারেল ইন্সটিটউট অব টেকনোলজির জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ড. অ্যাঞ্জেলিকা হিলবেক, ইউনিভার্সিটি অব অকল্যান্ডের অধ্যাপক ড. রবার্ট মান প্রমুখ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি অ্যান্ড ফার্মাকোলজি বিভাগের শিক্ষক যোবায়ের আল মাহমুদ বাংলানিউজকে বলেন, বাংলাদেশের বায়োসেফটি গাইডলাইন অনুযায়ী, জিএমও’র ব্যবহার যেন জীববৈচিত্র্য ও জেনেটিক সম্পদের সুরক্ষার প্রতি হুমকি হয়ে না দাঁড়ায় তা সুনিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা গভীর উদ্বেগ জানিয়ে বলেছেন, এই বেগুন প্রাণবৈচিত্র্যের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। আর বায়োসেফটি নিয়ে নীতিমালা থাকলেও কোনো আইন নেই এখনো পর্যন্ত আমাদের দেশে।
তিনি আরও বলেন, বিটি জিন আশপাশের বেগুনের জাতের কাছাকাছি অন্যান্য জাত ও প্রজাতির বুনো গাছপালা শাক-সবজি ঝোপঝাড় লতাপাতায় পরপরাগায়নের মাধ্যমে দূষণের জন্ম দিতে পারে। এই ঝুঁকি প্রশোমনের ব্যাপারটি বিবেচনা করা হয়নি। বেগুনের অন্যান্য প্রজাতি কিংবা অন্য উদ্ভিদে এই বিটি জীনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরাগায়ন প্রতিবেশগত সমস্যা তৈরি করবে।
ফলে জীববৈচিত্র্যের জন্য এটা হুমকি। বিটি জিন ট্রান্সফার অন্যান্য অস্তন্যপায়ী প্রাণীদের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে যেমন তা ক্ষতিকর পোকার প্রতিরোধে কার্যকর হলেও অনেক উপকারী পোকামাকড় ও প্রজাপতিরও ক্ষতিসাধন করতে পারে।
অন্যদিকে, একটি স্বাধীন গবেষণার মাধ্যমে জিন বদলে উত্পাদিত বেগুন স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কি-না তা নির্ধারণ না করা পর্যন্ত বিটি বেগুনের বাণিজ্যিক ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে হাইকোর্ট।
বিটি বেগুন কৃষকদের কাছে ছাড়ার আগে এতে জনস্বাস্থ্যের মারাত্মক ঝুঁকি এবং ইকোলোজিকাল ভারসাম্য বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নে বিবাদীদের ব্যর্থতা কেন আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না- তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন উচ্চ আদালত।
একটি স্বাধীন গবেষণার মাধ্যমে মানবদেহ, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের উপর বিটি বেগুনের প্রভাব নিরূপণ করা এবং গবেষণার রিপোর্ট জনসম্মুখে প্রকাশ করা আদালতের নির্দেশ।
ঠিক এমন একটি সময়ে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে বীজ ছাড়ের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারটি পরিবেশবিদদের মধ্যে শঙ্কার সৃষ্টি করেছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৩০৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৮, ২০১৩
এনকে/এএ/বিএসকে