ঢাকা, শনিবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

উপকূল থেকে উপকূলে

সবুজ শূন্য জলবায়ু, ফসল হারাচ্ছে গ্রাম

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪১৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৯, ২০১৩
সবুজ শূন্য জলবায়ু, ফসল হারাচ্ছে গ্রাম

পাথরখালী (কয়রা, খুলনা) ঘুরে এসে: বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে প্রতি বছর ধনী-গরিব দেশের নেতারা ক্ষতিপূরণের দাবি নিয়ে দরকষাকষি করেন। কিন্তু বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলের লাখো মানুষের অবস্থার বদল হয় না।



জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার এ অঞ্চলের মানুষগুলো প্রতিনিয়ত নানা সংকটের মুখে পড়ছে। এলাকায় ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব।

সুন্দরবন লাগোয়া কয়রা অঞ্চলের কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, রং বদলে সবুজ গ্রাম বিরান মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে। জমিতে ফসল নেই। মানুষ কর্মহীন। জলবায়ুর পরিবর্তনে জনজীবনের চিরাচরিত বৈশিষ্ট্য বদলে যাচ্ছে।

তাপমাত্রা বাড়ছে, সমুদ্র থেকে আসা পানিতে লবণাক্ততা বেড়েছে, বেড়ে যাচ্ছে জোয়ারের উচ্চতা, বদলে যাচ্ছে কৃষি বৈচিত্র্যের ধরণ, মরে যাচ্ছে গাছপালা। এলাকার মানুষের পর্যবেক্ষণ থেকে জানা যায়, এ অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা দিন দিন প্রকট হচ্ছে।

জোয়ারের পানির উচ্চতা
স্থানীয় লোকজনের পর্যবেক্ষণ বলছে, এ এলাকার নদনদীতে জোয়ারের পানির উচ্চতা বেড়েছে। আগে নিচু বাঁধ উপচে পানি ভেতরে যেতে পারতো না। এখন বাঁধ উঁচু করার পরও পানিতে প্লাবিত হয় গ্রাম। ফলে এলাকার মানুষের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এসেছে। বাড়িঘর উঁচু করতে হচ্ছে। অন্যদিকে জোয়ারের পানির চাপ বেড়ে যাওয়ায় নদীর ভাঙন তীব্র হচ্ছে।  

সুন্দরবনের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া শাকবাড়িয়া নদীর তীরে বাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে শাকবাড়িয়া গ্রামের ৭৫ বছর বয়সী নৃপেন্দ্র নাথ সরকার বাংলানিউজকে বলেন, আগে এ বাঁধ মাত্র পাঁচ ফুট উঁচু ছিল। তখন জোয়ারের পানি রাস্তার ওপর উঠতে দেখিনি। এখন ১৪ ফুট উঁচু বাঁধ উপচে পানি ভেতরে ঢুকে। বাংলা সনের ফাল্গুন-চৈত্র থেকে কার্তিক-অগ্রহায়ন অবধি পানি বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

পানির লবণাক্ততা
এ এলাকার পানিতে লবণের মাত্রা তীব্র হয়েছে বলে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন। তারা বলেন, পৌষ মাসের শেষের দিকে পানিতে লবণাক্ততা বাড়তে শুরু করে। নদীতে গোসল করলে শরীরে লবণ জমে যায়। লবণের কারণে পানির ভেতরে আগুনের ফুলকি বের হয়। আবার পানি চুলার আগুনে জ্বাল দিয়েও লবণের তীব্রতার প্রমাণ মিলেছে।

পাথরখালীর বয়সী ব্যক্তি আবুল আসাদ বলেন, বর্ষা মৌসুমে এ শাকবাড়িয়া নদীর পানি একেবারেই মিষ্টি হয়ে যেতো। আর এখন বর্ষাকালেও পানি মুখে দেওয়া যায় না।    

তাপমাত্রা
তাপমাত্রা বৃদ্ধির নানামুখী নির্দেশক তুলে ধরেন সুন্দরবন লাগোয়া গ্রামগুলোর বাসিন্দারা। চৈত্র মাসে তাপমাত্রা অত্যাধিক বেড়ে যায়। রাস্তা দিয়ে তখন খালি পায়ে হাঁটা যায় না। তীব্র তাপের দহনে গোটা এলাকা যেন খাঁ খাঁ করে। গাছপালা কমে যাওয়ায় গরমের মাত্রা এতটা বেড়েছে বলে এলাকাবাসীর ধারণা। যখন বেশি গাছপালা ছিল, তখন তাপ এত বেশি ছিল না।

গাছপালা মরে যাচ্ছে
কয়রা উপজেলা সদর থেকে উত্তর বেদকাশী ইউনিয়ন, সেখান থেকে সুন্দরবন লাগোয়া গ্রাম পাথরখালী। এ গ্রামে ঢুকে সমস্যার কথা জানাতে চাইলে মোস্তাফিজুর রহমান, নিত্যানন্দ, রোকেয়া বেগম, আবুল আসাদ ছাড়াও অনেকেই জানালেন, এলাকার গাছপালা মরে যাচ্ছে। গ্রামটি এক সময় সবুজে পরিপূর্ণ ছিল। বিভিন্ন ধরনের ফলের গাছ ছিল প্রত্যেক বাড়িতে। এখন তা হারিয়ে গেছে।

কয়রা শহর থেকে যতটাই সুন্দরবনের দিকে আসছিলাম, ততই বিরান ভূমি চোখে ভেসে ওঠে। গাছপালা বিহিন শূন্য ভিটায় পড়ে আছে বাড়ি। কেউ কেউ নতুন করে গাছপালা লাগানোর চেষ্টা করছেন। তবে তা সেভাবে বেড়ে উঠছে না। স্থানীয় লোকজন বাংলানিউজকে জানান, ২০০৯ সালে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে এ এলাকা সবুজশূন্য হতে শুরু করে। এখন তেমন কোনো গাছপালা হচ্ছে না।    

ফসলের বৈচিত্র্য
ধান করলে মারা পড়ে। চিংড়ি করলে ভাইরাস ধরে। আমরা যে কোথায় যাই। শাকবাড়িয়া গ্রামের অনিল ঘরামীর এ কথাই এ এলাকার ফসলে অবস্থা বলে দেয়। ফসলি মাঠের দিকে তাকালে দেখা যায় শুধু ধু ধু মাটি আর মাটি। কোথাও এক টুকরো সবুজ ফসলের দেখা মেলে না।

ভর দুপুরে শাকবাড়িয়া গ্রামের একটি দোকানে জড়ো হয়েছিলেন কেশব ঘরামী, সবিতা রানী সরকার, গনেশ সরদারসহ আরও অনেকে। তারা জানান, এ এলাকার জমিতে বরান, পানবট, ঘুনসি, মাইলে কড়ি, পাইজাম, হোগলা, দাইসসেলসহ নানা জাতের ধানের আবাদ হতো। লবণ পানি ঢুকে ধানের সর্বনাশ করে দিয়েছে। ঘূর্ণিঝড় আইলার আগেও কিছু কিছু এলাকায় ধানের আবাদ হতো। আইলার পরে একেবারেই হচ্ছে না।     

খাবার পানির সংকট
আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে এলাকায় পানি সংকট বেড়ে যাওয়ার কথা জানালেন স্থানীয় বাসিন্দারা। পানির জন্য গ্রামের জলাধারগুলো লবণ পানিতে ডুবে যাওয়ার কারণে ওই পানি এখন খাওয়ার অযোগ্য।

অনেক এলাকায় গভীর নলকূপ বসে না। আবার কোথাও বসানো সম্ভব হলেও লবণ পানি ওঠে। কয়রার উত্তর বেদকাশী, দক্ষিণ বেদকাশী, কয়রা সদও, বাগদী ছাড়াও বিভিন্ন এলাকায় নানামুখী প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে পানির সংকট তীব্র হয়েছে।

উপকূল অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব ক্রমেই দৃশ্যমান হচ্ছে। এমন দাবি জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কর্মরত বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা উত্তরণ পরিচালক শহীদুল ইসলামের। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, কিছু বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর কাজ চলছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি যেহেতু দীর্ঘমেয়াদি, তাই মানুষের অভ্যাস পরিবর্তনের বিষয়টি জরুরি। এ জন্য আরও নিবিরভাবে কাজ করতে হবে।

বাংলাদেশ সময়: ০৪১২ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৯, ২০১৩
আরআইএম/এসএইচ/এমজেডআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।