ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

উপকূল থেকে উপকূল

অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা, সুফল আসেনি কোনো প্রকল্পেই

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫৫৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১, ২০১৩
অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা, সুফল আসেনি কোনো প্রকল্পেই

[জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে মরছে কপোতাক্ষ। দিনে দিনে পরিবর্তনের প্রভাবকগুলো আরও দৃশ্যমান হচ্ছে।

এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে অপরিকল্পিত উন্নয়ন। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্মৃতিঘেরা এ নদীর মৃত্যুঘন্টা ক্রমেই ঘনিয়ে আসছে। কপোতাক্ষের বড় অংশ মরে গিয়ে লাখো মানুষের সংকট বাড়িয়েছে। বছরের প্রায় ছ’মাস জলাবদ্ধতায় ডুবছে বাড়িঘর-রাস্তাঘাট। প্রতিনিয়ত যোগ হচ্ছে নতুন সংকট। কোটি কোটি টাকার প্রকল্প নেয়া হয়, সংকট কাটে না। কপোতাক্ষ-তীর ঘুরে এইসব বিষয়ে আদিঅন্ত খোঁজ নিয়ে ‘কপোতাক্ষে বাঁচামরা’ শিরোনামে বাংলানিউজের ছয় পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের তৃতীয় পর্ব ]

Rafiqul-islam20কপোতাক্ষতীরের জলাবদ্ধ এলাকা ঘুরে এসে: বছরে বছরে কপোতাক্ষ খনন আর সংযোগ খাল সংস্কারে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হলেও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জলাবদ্ধতা নিরসন হচ্ছে না। কপোতাক্ষের প্রবাহ ঠিক রাখতে নদীখনন ছাড়াও সরকারি বিভিন্ন বরাদ্দে সংযোগ খাল সংস্কারের প্রকল্প নেওয়া হয়। এতে জলাবদ্ধতা নিরসন না হয়ে বরং বাড়ছে মানুষের দুর্ভোগ।

তালা ও পাইকগাছাসহ কপোতাক্ষতীরের বিভিন্ন এলাকা সরেজমিনে ঘুরে কপোতাক্ষ খনন কাজে অনিয়ম চোখে পড়ে। প্রায় প্রতিবছরই কপোতাক্ষ সচল রাখতে খননকাজ চলে। দরপত্র অনুযায়ী কপোতাক্ষের মাঝখান দিয়ে সরু চ্যানেলটি দেড় মিটার গভীর, ১০ মিটার চওড়া, দেড় মিটার পার্শ্ব ঢাল থাকার কথা থাকলেও এই মাপ অনুযায়ী কাজ হয় না কখনোই।

অন্যদিকে খননকৃত মাটি ৫০ মিটার দূরে ফেলার কথা থাকলেও দেখা যায় নদীর পাশেই রাখা হয়।

কপোতাক্ষ খনন প্রসঙ্গে খুলনার পাইকগাছায় কপোতাক্ষ তীরের দেওরা গ্রামের লোকজন বলেন, ‘নদীর মাটি নদীতেই ফেলা হচ্ছে। এই খনন কোনো কাজে লাগছে না। তীরে রাখা মাটি জোয়ারের পানিতে ধুয়ে নদীতে পড়ছে। ’ তারা জানান, প্রতি বছর এভাবেই নামমাত্র খনন করা হচ্ছে। তাই তাতে কোনো কাজ হচ্ছে না। কপোতাক্ষ মরে যাওয়ায় আমরা জলাবদ্ধতায় ডুবছি। জমিতে ফসল ফলাতে পারছি না। ’
DSC-bg
একাধিক এলাকা ঘুরে দেখা যায়, কপোতাক্ষের খননকৃত মাটি নদীতেই ফেলা হচ্ছে। কপোতাক্ষ খননে প্রতি বছর বরাদ্দ দেওয়া হলেও প্রতিবছরই নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে, বাড়ছে মানুষের কষ্ট। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোটি কোটি টাকা যাচ্ছে পানির নিচে।
 
কপোতাক্ষ তীরের গোলাবাটি (সলুয়া) এলাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আবুল হোসেন বলেন, গতবছর গোলাবাটি এলাকায় কপোতাক্ষ খনন করা হয়েছিল। দু’মাস না যেতেই তা আবার পলি পড়ে ভরাট হয়ে যায়। একই স্থানে এবছরও খনন হয়েছে। একই এলাকার হাফিজুর রহমান, আব্দুল করিম, ইমান সরদারসহ অনেকেই একই অভিযোগ করে বলেন, খননে সীমিত সময়ে উপকারে আসে। কিন্তু খনন করা মাটি আবার নদীতে ফেলায় নদী আবার ভরাট হয়ে যায়।

খননকাজে অনিয়মের অভিযোগ প্রসঙ্গে যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, পলি জমে নদী ভরাট হওয়ায় প্রতিবছর খনন কাজ চালিয়ে যেতে হচ্ছে। এটা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিয়মিত কাজ। দরপত্র অনুযায়ী খনন নিশ্চিত করতে মাঠ পর্যায়ে বোর্ডের লোকজন কাজ তদারক করছে। অনিয়মের সুযোগ নেই।
DSC-220        
সংযোগ খাল খনন হচ্ছে না
কপোতাক্ষে পানির প্রবাহ নিশ্চিত করতে এ নদীর সংযোগ খালগুলো সংস্কার করা হচ্ছে প্রতি বছর। কাবিটার (কাজের বিনিময়ে টাকা) অধীনে তালা উপজেলার তেমনই ৪টি প্রকল্পে কোন কাজই হয়নি। কোথাও দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে এলাকাবাসী কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। সরেজমিন ঘুরে এমন তথ্য মেলে।

এলাকা ঘুরে জানা গেছে, কাবিখা (কাজের বিনিময়ে খাদ্য) প্রকল্পের তালা উপজেলার তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের প্রভাষ দাসের বাড়ী থেকে মাহমুদপুর পর্যন্ত প্রায় ১২শ’ফুট রাস্তা নির্মাণে ১৩টন গম বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। প্রকল্প কমিটি নির্দিষ্ট সময়ের কিছু পরে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কারে কাবিটার আওতায় ধলবাড়িয়া-কেশারবিল গেট পর্যন্ত খাল খননে ৮ লাখ টাকার কাজ শুরু হলে ঐ প্রকল্পের শ্রমিকদের দিয়ে কাবিখার রাস্তার কাজ করানো হচ্ছিল। বিষয়টি জানতে পেরে এলাকাবাসী কাজ বন্ধ করে দেয়।
 
উপজেলার সরুলিয়া ইউনিয়নের কামারডাঙ্গী খাল খনন প্রকল্পে দেওয়া হয় ১২ লাখ টাকা। সেখানে দেখা গেছে, নামমাত্র খনন করা হয়েছে। এলাকাবাসী জানিয়েছে, খালটি খননের নামে যে বরাদ্দ এসেছে, তা ব্যয় হয়নি। খালটি আগের মতই আছে।
 
তালার খলিলনগর ইউনিয়নে বাটুলতলা স্লুইসগেট থেকে খলিলনগর অভিমুখী খাল খননে বরাদ্দ হয়েছিল ৫ লাখ টাকা। এলাকা ঘুরে খালটি সংস্কার হয়েছে বলে মনেই হয়নি। এলাকার বয়স্ক ব্যক্তি রহমত আলী আঙ্গুল তুলে দেখালেন এ খালের মাঝ বরাবর সামান্য কাজ হয়েছে। এতে খালের কোন পরিবর্তন হয়নি।
DSC-12 
খাল সংস্কারে অনিয়ম প্রসঙ্গে তালা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, কাজগুলো যথাযথভাবে হয়েছে। কাজ তদারকির জন্য মনিটরিং কমিটি ছিল। তারা সব দেখেশুনে প্রতিবেদন দিয়েছে।

বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম
জলাবদ্ধতা নিরসনে বিভিন্ন সময়ে কপোতাক্ষতীরে বাঁধ নির্মাণ করা হলেও তা কোনো কাজে আসেনি। অনেক স্থানে বাঁধ নিচু হওয়ার কারণে বাঁধ উপচে পানি ঢুকেছে। আবার কোথাও বাঁধের কাজ হয়েছে নামমাত্র। কপোতাক্ষতীরের মানুষ অভিযোগ করেন, শুধু প্রকল্প দেখানোর জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। মানুষের উপকারে আসে না।    
 
সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, তালার মোবারকপুর এলাকায় কপোতাক্ষতীরের বাঁধ নির্মাণের জন্য ২০০৯ সালে কর্মসৃজন প্রকল্পের আওতায় ১০০ দিন করার কথা থাকলেও সেখানে কাজ হয়েছে মাত্র ৫০দিন। ফলে বাঁধ যথাযথভাবে নির্মিত হয়নি।

উপজেলার শ্রীমন্তকাঠি জেলেপাড়া থেকে খেরসা ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত আট কিলোমিটার কপোতাক্ষ বেড়িবাঁধ নির্মাণে ৬০ লাখ টাকা বরাদ্দ হয়েছিল। এখানে কাজ হয়েছে বলে মনে হয়নি। মাগুরা ইউনিয়নের বারইপাড়া থেকে মাগুরা বাজার অভিমুখে ২ লাখ টাকা ব্যয়ে কপোতাক্ষ তীরের বাঁধ নির্মাণের জন্য প্রকল্প নেওয়া হলেও দেখে মনে হয়েছে কোন কাজই হয়নি।
 
তদন্ত হয়, ব্যবস্থা নেওয়া হয় না
জলাবদ্ধতা নিরসনে কপোতাক্ষ খনন, বাঁধ নির্মাণসহ বিভিন্ন সময় নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। দুর্নীতি ও লুটপাটে ব্যাপক তোলপাড় হলে কর্তৃপক্ষ তড়িঘড়ি ‘লোক দেখানো’ তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় নি।
 
পানি কমিটির সভাপতি শফিকুল ইসলাম বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকল্প তৈরিতে দুর্নীতি হয়। এলাকার মানুষ বেশি কথা বললে তদন্ত কমিটি হয়। নামেমাত্র তদন্তও হয়। কিন্তু এ পর্যন্তই শেষ।

বাংলাদেশ সময়: ০৫৫৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০১, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।