ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

উপকূল থেকে উপকূল

অনিশ্চিত জোয়ারাধার, ভরসা নেই চাষিদের

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২২৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৪, ২০১৩
অনিশ্চিত জোয়ারাধার, ভরসা নেই চাষিদের

Rofiqul-sm2জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে তিলে তিলে ম‍ারা পড়ছে কপোতাক্ষ। দিনে দিনে পরিবর্তনের প্রভাবকগুলো আরও দৃশ্যমান হচ্ছে।

সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে অপরিকল্পিত উন্নয়ন। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্মৃতিঘেরা এ নদীর মৃত্যুঘণ্টা ক্রমেই এগিয়ে আসছে।

কপোতাক্ষের বড় অংশ মরে গিয়ে লাখো মানুষের সংকট বাড়িয়েছে। বছরের প্রায় ছ মাস জলাবদ্ধতায় ডুবছে বাড়িঘর-রাস্তাঘাট। প্রতিনিয়ত যোগ হচ্ছে নিত্যনতুন সংকট। কোটি কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। তবুও কাটছে না সংকট। কপোতাক্ষ তীর ঘুরে এসব বিষয়ে আদিঅন্ত খোঁজ নিয়ে ‘কপোতাক্ষে বাঁচামরা’ শিরোনামে বাংলানিউজের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের এটি পঞ্চম পর্ব।

কপোতাক্ষ তীরের জলাবদ্ধ এলাকা ঘুরে এসে: নদী থেকে আসা জোয়ারের পানি বিলে ঢুকিয়ে নিচু জমিতে পলি জমানো হয়। এভাবে কবছরে পলি জমে নিচু পতিত জমি আবাদের উপযোগী হয়ে ওঠে। সারা বছর অথৈ পানিতে ডুবে থাকা বিলের জমি সবুজে সবুজে ভরে ওঠে। এতে লাভবান হন চাষিরা।

নদীতে আসা জোয়ারের পানি বিলে দিয়ে জমিকে আবাদি করে তোলার এ পদ্ধতির নাম জোয়ারাধার। ইংরেজিতে একে বলে টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট (টিআরএম)। যথাযথভাবে জোয়ারাধার বাস্তবায়ন না করে নদী খনন করলে তা টেকসই হবে না।
upoku-bg2
বিলে পানি না জমে যাতে সহজেই নদীতে প্রবাহিত হতে পারে। সে জন্যই জোয়ারাধারের এ ব্যবস্থা। কিন্তু এলাকা ঘুরে জানা গেছে নানামুখী জটিলতায় জোয়ারাধার বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্থ হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কপোতাক্ষ খননের আগে সাতক্ষীরার তালা উপজেলার পাখিমারা বিলে এবার জোয়ারাধার বাস্তবায়নের পরিকল্পনা আছে। এ বিলের আশপাশের এলাকা ঘুরে জানা যায়, সরকারি দপ্তরের আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে জোয়ারাধার বাস্তবায়নের কাজ এগোচ্ছে নিতান্তই ধীর গতিতে। প্রকল্পের জন্য সরকারকে জমি লিজ দিতে সাধারণ মানুষ আস্থা পাচ্ছে না। অন্যদিকে জমির কাগজপত্র জমা দিয়ে লিজের টাকা পেতে অপেক্ষা করতে হচ্ছে মাসের পর মাস।

সূত্র বলছে, জোয়ারাধার বাস্তবায়নের জন্য বিলের সব জমি নির্ধারিত মূল্যে সরকার লিজ নেয়। প্রতি বিঘা জমির এক বছরের লিজ বাবদ চাষিদের দেওয়া হচ্ছে ১৪ হাজার ২৩৫ টাকা করে।

এসব লিজের টাকা পেতে হলে দশ-বারো ধরনের কাগজ সংগ্রহ করে জমা দিতে হয়। এসব কাগজপত্র সংগ্রহে ৫-৬ হাজার টাকা লেগে যায়। এ টাকার বিনিময়ে কাগজপত্র জমা দিয়ে লিজের টাকা পাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় থাকায় অনেকেই কাগজ জমা দেওয়া তো দূরের কথা, কাগজপত্র সংগ্রহই করেনি।
upok
পাখিমারা বিল লাগোয়া তেঘরিয়া গ্রামের বাসিন্দা যতীন্দ্র নাথ হাওলাদার বাংলানিউজকে বলেন, বিলে ৭৯ শতাংশ জমি আছে। জমির কাগজপত্র সংগ্রহ করতে পারিনি। ’৬২ সালের রেকর্ড, ৫টি খতিয়ানের আলাদা রেকর্ড, জেলা সদর সাতক্ষীরায় গিয়ে এসএ রেকর্ড তুলতে হবে।

এসব অনেক ঝুট-ঝামেলার কাজ। চাকরি ফেলে এসব কাগজ সংগ্রহ করতে যাওয়ার সময় পাচ্ছি না। তা ছাড়া অনেকে এত কষ্ট করে কাগজপত্র জমা দিয়েও পায়নি লিজের টাকা।

বালিয়া গ্রামের ফজলুর রহমান বলেন, কাগজপত্র তৈরি করতে প্রায় তিন মাস লেগেছে। কাগজপত্র জমা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু চেক পাইনি। আবার শুনেছি যারা চেক পেয়েছেন তারাও ব্যাংকে গিয়ে টাকা তুলতে নানা জটিলতায় পড়ছেন। নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে।

মুরাগাছা গ্রামের আনোয়ার হোসেন শেখ এখনো জমির কাগজপত্র তৈরি করার কথা ভাবছেন না। তিনি বলেন, টাকা-পয়সা খরচ করে কাগজ জমা দেব। লিজের টাকা পাবো কি না বলতে পারছি না। যারা কাগজ জমা দিয়েছে, তারা টাকা তুলুক। তারপর কাগজ জমা দেই।

সূত্র বলছে, পাখিমারা বিলে মুরাগাছা, বালিয়া, তেঘরিয়া, শুভঙ্করকাঠি, দোহার, সাতপাকিয়া, আমড়াডাঙ্গা, গৌতমকাঠি ছাড়াও ১২টি গ্রামের চাষিদের জমি আছে। বিলের জমিতে দীর্ঘদিন ধরে মাছ চাষ হচ্ছে। ঘের মালিকেরা চাষিদের কাছ থেকে বছরে বিঘাপ্রতি ৬ হাজার টাকার বিনিময়ে জমি লিজ নিয়ে মাছ চাষ করে।

আর জোয়ারাধার বাস্তবায়নের জন্য সরকারের কাছ থেকে চাষিরা পাচ্ছে বিঘাপ্রতি বছরে ১৪ হাজার ২৩৫ টাকা। জোয়ারাধার বাস্তবায়নে যত বছর লাগবে সরকার এ টাকা দেবে। ফলে চাষিরা লাভবান হচ্ছে। তবে বিক্ষুব্ধ ঘের মালিকরা। জোয়ারাধার বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে সদাই তৎপর আছে একটি চক্র।

সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র বলছে, এরই মধ্যে পাখিমারা বিলের জমির মালিকেরা জমির ক্ষতিপূরণের টাকা পেতে শুরু করেছেন। সব সমস্যা কাটিয়ে দ্রুত যাতে এ টাকা বিতরণ সম্পন্ন করা যায় এ বিষয়ে তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
upok
কিন্তু এরই মধ্যে ৪ বছর মেয়াদি প্রকল্পের দু বছর অতিবাহিত হলেও জোয়ারাধার শেষ হয়নি। ৯০ কিলোমিটার কপোতাক্ষ খননও কাজ শুরু হয়নি। ফলে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে নদের সংকটজনক অবস্থার কারণে পাখিমারা বিলে জোয়ারাধার বাস্তবায়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এ কারণে প্রকল্পটি নতুন করে ডিজাইন করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা মনে করেন, জোয়ারাধার বাস্তবায়ন করতে না পারলে নদী খনন করে সুফল পাওয়া যাবে না। এ জন্য সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষের সহায়তা দরকার। অনেক স্থানে মানুষের প্রতিরোধের মুখে জোয়রাধার বাস্তবায়ন করা যায় না।

প্রসঙ্গত, ২০০৪-০৫ সালে যশোরের মনিরামপুরের ভবদহে বিল কোদালিয়া ও বিল বকরে আলাদা দুটি টিআরএম-এ সুফল পাওয়া গেছে। এ প্রক্রিয়ায় বিলের চারপাশে বেড়িবাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকানো হয়। এ জোয়ারের পানি জমিতে পলি ফেলে চলে যায়। ফলে পলি পড়ে জমি চাষাবাদের জন্য উর্বর হয়ে ওঠে, কেটে যায় জলাবদ্ধতা।

সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্র্যাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) জলাবদ্ধতা নিরসনে জোয়ারাধার বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছে। ২০০৪ সালের এ রিপোর্টে কপোতাক্ষের ঝাঁপার বাওড়ে এ পদ্ধতি বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়। ওই সময় ঝাঁপার বাওড় অবধি জোয়ার প্রবাহিত হওয়ার সুযোগ ছিল। এখন জোয়ার প্রবাহিত হয় তালার উপজেলার মাগুড়া অবধি। এ কারণে এ এলাকায় এখন জোয়ারাধার বাস্তবায়ন প্রয়োজন।

আগে সাতক্ষীরার তালার উপজেলার জেঠুয়া বিলে বাস্তবায়িত হয় জোয়ারাধার। ওই এলাকার চাষি আনোয়ার হোসেন বলেন, নদী বাঁচাতে জনগণের অংশগ্রহনের ভিত্তিতে পরিকল্পিতভাবে জোয়ারাধার বাস্তবায়ন করতে হবে।

বিল ভরাট হয়ে চাষাবাদের উপযোগী না হওয়া অবধি বিলের ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। পলি জমে বসতি এলাকার তূলনায় যাতে বিল বেশি উঁচু না হয়ে যায়, সেদিকেও নজর রাখতে হবে সংশ্লিষ্টদের।

বাংলাদেশ সময়: ০২১২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৪, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।