জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে তিলে তিলে মারা পড়ছে কপোতাক্ষ। দিনে দিনে পরিবর্তনের প্রভাবকগুলো আরও দৃশ্যমান হচ্ছে।
কপোতাক্ষের বড় অংশ মরে গিয়ে লাখো মানুষের সংকট বাড়িয়েছে। বছরের প্রায় ছ মাস জলাবদ্ধতায় ডুবছে বাড়িঘর-রাস্তাঘাট। প্রতিনিয়ত যোগ হচ্ছে নিত্যনতুন সংকট। কোটি কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। তবুও সংকট থেকেই যাচ্ছে। কপোতাক্ষ তীর ঘুরে এসব বিষয়ে আদিঅন্ত খোঁজ নিয়ে বাংলানিউজের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ শেষ কিস্তি।
কপোতাক্ষ তীরের জলাবদ্ধ এলাকা ঘুরে এসে: কপোতাক্ষ মরে যাওয়া আর এর প্রভাবে বিরাট এলাকা জুড়ে জলাবদ্ধতার এ সংকট যুগ-যুগের। ষাটের দশকে উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণের মধ্যদিয়ে এ অবস্থার সূত্রপাত।
একদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, অন্যদিকে একের পর এক অপরিকল্পিত উন্নয়ন। এভাবেই যুগ-যুগে সংকট ক্রমশ বেড়েছে। এলাকাবাসীর প্রশ্ন, এ সংকট কাটতে কত যুগ লাগবে?
জলাবদ্ধতা নিরসনে কপোতাক্ষ বাঁচানোর তাগিদ দিয়েছেন স্থানীয়রা। একদলের দাবি ঝুঁড়ি কোদাল দিয়ে নদী খননের। আরেক দল বলছেন খনন যেভাবেই হোক না কেন, উজানে পদ্মা, ভৈরব ও মাথাভাঙ্গা নদীর সঙ্গে কপোতাক্ষের সংযোগ ঘটাতে না পারলে এ অঞ্চলের মানুষ জলাবদ্ধতার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না। তবে খনন টেকসই করতে জোয়রাধার বাস্তবায়নের দাবি সবারই।
কপোতাক্ষ খনন তথা জলাবদ্ধতা নিরসনে সবচেয়ে বড় প্রকল্পের সফলতার আশা করে পানি উন্নয়ন বোর্ড বলেছে, নতুন প্রকল্পে জোয়ারাধার বাস্তবায়নে কিছু অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে। কপোতাক্ষসহ এর সংযোগ খাল খনন করা হবে। ফলে জলাবদ্ধতা থেকে যেমন এলাকার মানুষ রক্ষা পাবে, তেমনি এলাকার মাঠ-ঘাট ভরে উঠবে সবুজে।
বেসরকারি সংগঠন উত্তরণের সমীক্ষা থেকে জানা যায়, এরই মধ্যে জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রকল্পগুলো কোনো কাজে আসেনি। একাধিক প্রকল্পের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল এলাকার মানুষ। অপরিকল্পিত এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে জলাবদ্ধতা আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় এলাকাবাসী সেসব প্রকল্প প্রত্যাখান করে, প্রতিরোধ করে।
ভুল প্রকল্পের বিরুদ্ধে সোচ্চার
এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের সহায়তায় ১৯৮৫ সালে বিল ডাকাতিয়া অঞ্চলের ৩১ হাজার ৯০০ হেক্টর জমির জলাবদ্ধতার কারণ অনুসন্ধানে সমীক্ষা চালানো হয়। এর ভিত্তিতে ইউএনডিপি ও এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের সহায়তায় ১৯৮৯ সালে খুলনা উপকূলীয় বাঁধ পূনর্বাসন প্রকল্প (কেসিইআরপি) নেওয়া হয়। সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ এ প্রকল্পগুলোর বিরুদ্ধে এলাকাবাসী তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করে। আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯০ সালে প্রকল্পের কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করা হয়।
পরে খুলনা উপকূলীয় বাঁধ পূনর্বাসন প্রকল্প-২ (সিইআরপি-২) নামে নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকার উদ্যোগ নেয়। এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের সহায়তা এ প্রকল্পের আওতাভূক্ত ছিল ৯০ হাজার হেক্টর জলাবদ্ধ এলাকা। কিন্তু বাস্তবায়নের আগেই সরকার এ প্রকল্প পরিত্যক্ত ঘোষণা করে।
জলবদ্ধতা দূর করতে সরকারি উদ্যোগে এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের সহায়তায় খুলনা-যশোর নিষ্কাশন পুনর্বাসন প্রকল্প (কেজেডিআরপি) নেওয়া হয় ১৯৯৩-৯৪ সালে। কর্তৃপক্ষের প্রস্তাব ছিল এ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে যশোর ও খুলনা জেলার ৮টি উপজেলার একলাখ ৬ শ হেক্টর জমির জলাবদ্ধতা দূর হবে।
এ প্রকল্পের আওতায় একাধিক নদীতে বাঁধ, ক্রসড্যাম, বেড়িবাঁধ,স্লুইজগেট ইত্যাদি নির্মাণের পরিকল্পনা থাকায় এলাকাবাসী এ প্রকল্প বাস্তবায়নে আপত্তি জানায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্পের সম্ভাব্য সামাজিক ও পরিবেশ প্রতিক্রিয়া যাচাই করা হয়। এর পর থেকেই সরকার জোয়ারাধারের ওপর গুরুত্বারোপ করে।
এসব প্রকল্প সফল না হওয়া প্রসঙ্গে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বলেছেন, এরই মধ্যে কিছু প্রকল্প হয়তো বাস্তবসম্মত হয়নি। তবে কিছু প্রকল্প আবার সফলতার মুখও দেখেছে। কেজেডিআরপি-এর আওতায় জোয়ারাধারের মাধ্যমে ভবদহের জলাবদ্ধতা নিরসন করা হয়েছে।
শত্রু উপকূলীয় বাঁধ
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের সর্ববৃহৎ প্রাচীন নদ কপোতাক্ষ। প্রায় ৩৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ নদের ওপর প্রায় ২০ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষভাবে নির্ভরশীল। বিগত ৯০ দশকে এ অববাহিকার জলাবদ্ধতা সমস্যা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
২০০০ সাল থেকে এ সমস্যা স্থায়ী জলাবদ্ধতায় রূপ নেয়। ১৮৬২ সালে ব্রিটিশ সরকার ভারতের রানাঘাট হতে বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার সঙ্গে রেল লাইন স্থাপনের পর পরই পদ্মার সঙ্গে মাথাভাঙার ও কপোতাক্ষসহ সংযোগ নদীগুলো বিচ্ছিন্ন হয়। এ কারণে এ এলাকার নদীগুলো শুধু জোয়ার ভাটার নদীতে পরিণত হয়। গবেষণা সূত্র আর স্থানীয়রা এ তথ্য দিয়েছে।
সূত্র বলছে, ষাটের দশকে উপকূলীয় এলাকায় পোল্ডার ব্যবস্থার আওতায় নদী তীরে উপকূলীয় বাঁধ এবং পানি নিষ্কাশনের জন্য সুবিধাজনক স্থানে স্লুইস গেট নির্মাণ করা হয়। নির্মাণের পর ১০-১৫ বছর এ প্রকল্প লক্ষ্য পূরণে সফল হলেও এরপর থেকেই দৃশ্যমান গতে থাকে উল্টোচিত্র।
বাঁধ ও স্লুইস গেটের কারণে প্লাবনভূমি বা নদীর সঙ্গে সংযোগ বন্ধ হয়ে যায়। জোয়ার ভাটা নদীর মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। ফলে জোয়ার বাহিত পলি নদীর মধ্যেই অবক্ষেপিত হয়ে ১০-১৫ বছরের মধ্যে নদীবক্ষ তীরবর্তী খাল বিলের তুলনায় উঁচু হয়ে যায়। ফলে দেখা দেয় জলাবদ্ধতা। এ জলাবদ্ধতা ক্রমেই কপোতাক্ষ তীরবর্তী এলাকায় সম্প্রসারিত হতে থাকে।
জলাবদ্ধতা থেকে বাঁচতে বেসরকারি সংস্থা উত্তরণ, পানি কমিটি ও কপোতাক্ষ বাঁচাও আন্দোলন ছাড়াও অন্য সব স্থানীয় সংগঠন দাবি তোলে। সমস্যা সমাধানে সুবিধাজনক বিলে জোয়ারাধার বা টিআরএম বাস্তবায়ন, কপোতাক্ষ নদ খনন এবং পদ্মা প্রবাহের সঙ্গে কপোতাক্ষ নদের সংযোগের দাবি তোলে। কিন্তু পদ্মার সঙ্গে কপোতাক্ষের সংযোগের কোনো কার্যক্রম নেই বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পে।
বারো নদীর মৃত্যুঘণ্টা
জলাবদ্ধ এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণের ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১২টি নদীর মধ্যে ২টি কোনোমতে টিকে আছে। বাকি নদীগুলো শীর্ণ খালে পরিণত হয়েছে। শীতকালে নদীগুলো চেনাই মুশকিল।
শ্রীহরি, মুক্তেশ্বরী, ভদ্রা, আপার ভদ্রা, কপোতাক্ষ, চিত্রা, ভৈরব, টেকা, ভবদহ, বেত্রাবতী, হামকুড়াসহ বেশিরভাগ নদী এখন ধু-ধু মাঠ বা শীর্ণ খালের দশা পেয়েছে। ভৈরব ও কপোতাক্ষের আংশিক টিকে থাকলেও নদীর তলদেশ ভরাট প্রক্রিয়া যেভাবে চলছে, তাতে আগামী দু-এক বছরের মধ্যে এ দুটি নদীও পুরোপুরি শুকিয়ে যাবে। শুকিয়ে যাওয়া নদীর বেশির ভাগ অংশ দখল করে আছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা।
এলাকাবাসী জানিয়েছেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোই এসব নদী গলাটিপে হত্যা করেছে। আর বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, নদীর ওপর বিশ্বব্যাংক, ইউএসএইড ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের অর্থায়নে পানি উন্নয়ন বোর্ড দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে উন্নয়নের নামে যে স্থাপনা তৈরি করেছে সেগুলোই এসব নদীর জন্য কাল হয়েছে। মানুষের কাছ থেকে নদীর নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নিয়ে যন্ত্রের হাতে তুলে দেওয়ার কারণে এমন দুর্যোগ।
দাবি জনঅংশগ্রহণের
জলাবদ্ধতা নিয়ে কর্মরত বেসরকারি সংস্থা উত্তরণ পরিচালক শহীদুল ইসলাম বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। জনঅংশগ্রহণ ছাড়া কোনো প্রকল্প যথাযথভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
জোয়ারাধারসহ সব প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে পরিকল্পিতভাবে। এবারের সবচেয়ে বড় প্রকল্পটি নিয়ে এলাকার মানুষের মাঝে যে আশাবাদ সৃষ্টি হয়েছে, তাকে সফল বাস্তবায়নের পথে না নিতে পারলে এলাকার মানুষের সংকট কাটবে না।
কপোতাক্ষ বাঁচাও আন্দোলনের প্রধান উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ বাংলানিউজকে বলেন, অনুন্নয়ন, দখল আর সরকারি প্রকল্পে দুর্নীতি কপোতাক্ষ মরে যাওয়ার অন্যতম কারণ। কপোতাক্ষকে বাঁচাতে হলে উজানে পদ্মা, ভৈরব, মাথাভাঙ্গার সঙ্গে এ নদীর সংযোগ ঘটাতে হবে। তা না হলে জলাবদ্ধতা নিরসনে কোনো প্রকল্প সফল হবে না। জনগণের মতামত ভিত্তিতে কপোতাক্ষ খনন করতে হবে ঝুঁড়ি কোদাল দিয়ে।
বাংলাদেশ সময়: ০৪০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৫, ২০১৩