ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

উপকূল থেকে উপকূল

ভাঙছে নদীর বুক, পুড়ছে কপাল

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫১৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১০, ২০১৩
ভাঙছে নদীর বুক, পুড়ছে কপাল

চর এলাহী, কোম্পানীগঞ্জ, নোয়াখালী থেকে: কারো ঠাঁই হয়েছে বাঁধের ঢালে, আবার কারো অন্যের জমিতে। যারা এলাকায় কোথাও থাকার জায়গা পায়নি, তারা জীবিকার টানে পরিজনসহ ছুটেছেন অন্যত্র।

প্রতিনিয়ত এদের দল ভারি হচ্ছে। বাড়ছে আশ্রয়হীনের সংখ্যা। ভাঙন প্রতিরোধে নেই কোনো ব্যবস্থা। কোনো পুনর্বাসন কর্মসূচি নেই।

ওপারে সন্দ্বীপের উড়িরচর, এপারে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের চর এলাহী ইউনিয়ন। মধ্যখানে বয়ে চলেছে বামনী নদী। এ নদীর তীর ধরে চর এলাহীর বেশ কিছু গ্রাম ভাঙনে বিলীন। বাঁধের ওপরে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ে বিপন্ন জীবনের দৃশ্যপট। বাঁধের ওপর বসতিতে কথা বলার সময় সরেজমিন বাংলানিউজের মুখোমুখি হন অনেকেই। ভিড়ের মধ্যেই একজন আঙ্গুল উঁচু করে বলেন, ওই দরিয়াই আঙগো শেষ করল।

চর এলাহীর সবচেয়ে ভাঙনপ্রবণ এলাকা ক্লোজার ঘাট। বর্ষা আর শীত নেই, আষাঢ় আর শ্রাবণ নেই। ভাঙন এখানে কোনো ঋতুই মানে না। কিলোমিটারের পর কিলোমিটার ভেঙে চলেছে। ভাঙনের তীরে দাঁড়িয়ে অসহায় মানুষগুলোর নিঃশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

সকালে-সন্ধ্যায়-দুপুরে অনেকে এ বামনী নদীর তীরে এসে নিজের অজান্তে বাপদাদার ভিটের সন্ধান করে। রোববার এ ঘাটে গেলে ভিড় করেন সব হারানো নারী-পুরুষের।

ক্লোজার ঘাটে ভিড় জমান নদীর ভাঙনে নিঃস্ব গোলাম মাওলা, জাকির হোসেন, সিরাজ মিয়া, আবদুর রব, নাদের জামান, আবুল বাশার, দুলাল মিয়া, নাছিমা বেগম, লিলি বেগমসহ আরও অনেকে। এদের মধ্যে কেউ এক সপ্তাহের মধ্যে বাড়িঘর হারিয়েছে, কেউবা একমাস আগে। অনেকে শুধু বাড়িঘর সরিয়েছেন, গাছ কেটে নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ঘুরে দেখা গেল, কেউ বাঁধের পাশে, বাজারের এককোনে, অন্য বাড়ির পাশে ছোট্ট ঘর বানিয়ে কেনোমতে দিনানিপাত।

ক্লোজার ঘাটের পাশে বেড়িবাঁধের পাশে পরিবার-পরিজনসহ থাকছেন শাহ আলম। তিনি জানান, ছয়বার নদীতে তার বাড়ি বিলীন হয়েছে। ঘরের চারজন লোক নিয়ে তিনি এখন চরম সংকটে দিন কাটাচ্ছেন। একই এলাকার বাঁধের পাশের বাসিন্দা তাজুল ইসলামের বাড়ি ভেঙেছে চারবার। মিজানুর রহমান, রহমত আলী, আলী হোসেন, আলাউদ্দিন ছাড়াও অনেকে বাঁধের পাশে আশ্রয় নিয়েছেন।

চর এলাহী ইউনিয়ন পরিষদ সূত্র বলছে, ২০০৩ সাল থেকে এই এলাকায় ভাঙনের তীব্রতা বাড়তে থাকে। ইউনিয়নে প্রায় দুই হাজার পরিবার ভাঙনের শিকার। অন্তত তিন হাজার হেক্টর জমি বিলীন হয়েছে নদীতে। এদের কেউ বাঁধের পাশে, আবার অনেকে বিভিন্ন চরে আশ্রয় নিয়েছে। তবে ভাঙন রোধে কোনো কার্যকরি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

সূত্র বলছে, ইউনিয়নের পূর্ব চর লেংটায় এরশাদ কলোনিতে ২৫০টি পরিবারকে দু একর করে জমি দিয়ে পুনর্বাসন করা হয়। এ কলোনি সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে। সেখানে দুটি স্কুল, দুটি মসজিদ, একটি বাজার, একটি আশ্রয় কেন্দ্র ছিল। পাশে আরেকটি মাটির কিল্লায় ২৫টি পরিবার পুনর্বাসন করা হয়। সেখানেও একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল। তবে তা বিলীন হয়ে গেছে।

ইউনিয়নের পূর্ব লেংটা, চর লেংটা, চর লেংটা পাঁচ নম্বর সিট, চর এলাহী, দক্ষিণ চর এলাহী, ও চর গাঙচিলের আংশিক নদীতে বিলীন হয়েছে। পূর্ব গাঙচিলে ৩৫০টি পরিবার পুনর্বাসনের লক্ষ্যে একটি আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলেও সেটি এখন ভাঙনের মুখোমুখি। এখানকার প্রাথমিক বিদ্যালয়টি নদীতে হারিয়ে যাওয়ায় অন্তত সাত শ ছেলেমেয়ের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে আছে।

এলাকাবাসী জানান, ৫-৬ বছর আগে একবার ব্লক ফেলে ভাঙন রোধের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সে কাজ শেষ হয়নি। এরপর ভাঙন রোধে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। চর এলাহী, চর ফকিরাসহ ভাঙন কবলিত ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধিরা সম্মিলিতভাবে যোগাযোগ মন্ত্রী ছাড়াও সংশ্লিষ্ট মহলে আবেদন জানালেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

চর এলাহীর চাষি বেলাল হোসেন বলেন, মহিষমারা খাল ও চর এলাহী বাজার থেকে পূর্বমূখী খালে বাঁধ না থাকায় লবণাক্ত পানি ফসলি ক্ষেতে ঢুকে ফসল নষ্ট করছে। এবার লবণ পানি ঢোকায় অনেকের আমন ফসল নষ্ট হয়েছে। ইউনিয়নের যে পাশে লবণ পানি ঢোকেনি, সেখানে আমনের ভালো ফলন হয়েছে, আর যে পাশে পানি ঢুকেছে, সেখানে ফলন অনেক কম হয়েছে।

চর এলাহীসহ পার্শবর্তী ইউনিয়নে ভাঙন ঠেকাতে বামনী নদীতে আড়াআড়ি বাঁধের দাবি এলাকাবাসীর। তারা বলছেন, এলাকার মানুষদের বাঁচাতে অবিলম্বে নদী ভাঙন রোধে কার্যকরি ব্যবস্থা নিতে হবে।

চর এলাহী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল মতিন তোতা বাংলানিউজকে বলেন, ভাঙনের বিষয়টি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি, কিন্তু কাজ হয়নি।

ভাঙন রোধে চর এলাহী থেকে উড়িরচর আড়াআড়ি বাঁধ দিতে হবে। বিগত সরকারের আমলে এমন একটি প্রকল্পের নকশা ছাড়াও সব কিছু চূড়ান্ত থাকার পরও কাজটি শেষমেশ বাস্তবায়িত হয়নি। ভাঙন রোধ ছাড়াও ফসল বাঁচাতে মহিষমারা খাল দিয়ে লবণ পানি প্রবেশ বন্ধ করতে হবে।

বাংলাদেশ সময়: ০৫০২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১০, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।