যারা গাছটির উপকার পেয়েছেন তাদের কাছে এটি প্রাকৃতিক কিংবদন্তিতুল্য এক মহাভেষজ। অনাদিকাল ধরে মানুষদের ত্বকের সুরক্ষায় গাছটির ফল অপ্রতিদ্বন্দ্বী ওষুধ।
বাংলাদেশে মাত্র দুটো প্রাপ্তবয়স্ক চালমুগরা গাছ রয়েছে। এই গাছের তাৎপর্য এমন গভীর যে এর ফলের কস একটি বিশেষ রোগ নির্মূল করতে শতভাগ সফল। প্রাকৃতিক এ গুরুত্ববহ ওষুধি গাছটি আমাদের দেশ থেকে চিরতরে বিলুপ্ত হতে চলেছে।
লাউয়াছড়া ডাক বাংলোর সম্মুখভাগে গাছটি নিজের ডাল-পাতায় ভরে রেখে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। নিচেই তার নতুন প্রজন্ম! ছোট চালমুগরা গাছগুলো বড় গাছটির ছায়ায়-মায়ায় বেড়ে ওঠছে।
ডাক বাংলোর কেয়ারটেকার মো. আলী জানান, শুনেছি এই চালমুগরা গাছটির ফলের কষ প্রসাধনীতে ব্যবহার করা হয়। এর কষ নাকি আমাদের ত্বকের জন্য বেশ উপকারী।
কমলগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত হীড বাংলাদেশের ল্যাপ্রসি প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর পরেশ দেবনাথ বাংলানিউজকে বলেন, চালমুগরা গাছটি মহাবিপন্ন প্রজাতি। আমার জানা মতে, বাংলাদেশে শুধু দু’টি গাছই রয়েছে। একটি আমাদের লাউয়াছড়ায়; অপরটি রংপুরে।
‘যখন ল্যাপ্রসি বা কুষ্ঠ রোগের কোনো ওষুধ আবিষ্কার হয়নি, ওই সময় চালমুগরার তেল দিয়ে কুষ্ঠরোগীদের চিকিৎসা করা হতো। এরপর যখন কুষ্ঠরোগের উন্নতমানের প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হলো তখন আস্তে আস্তে এর ব্যবহার বন্ধ হয়ে গেলো। ’
এর ফলের উপকারিতা সম্পর্কে তিনি বলেন, এ গাছের ফলের ভেতরে তেলের মতো একটি তরল পদার্থ রয়েছে। এটি আঠালো ধরনের। কুষ্ঠরোগীদের ক্ষতস্থানে চালমুগরার ফলের রস লাগানো হতো। কয়েকদিন নির্দিষ্ট পরিমাণে ব্যবহারের পর ধীরে ধীরে ক্ষতস্থান সেরে উঠতো। বর্তমানে ল্যাপ্রসির জন্য রিফামপিসিন এবং ড্যাপসুন- দুটো উন্নতমানের এন্টিবায়োটিক বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে।
এ বৃক্ষ সম্পর্কে অতীত স্মৃতিমন্থন করে তিনি বলেন, আমি যখন ১৯৮৭ সালে ল্যাপ্রসির উপর প্রশিক্ষণ নেই, তখন থেকে জানি এ বৃক্ষের গুণাগুণ সম্পর্কে। ড্যাপসুন ও রিফামপিসিন ওষুধ যখন আবিষ্কৃত হয়নি তখন চালমুগরার তেল দিয়ে ভারতের মাদ্রাজে চিকিৎসা করে অনেক কুষ্ঠরোগীকে সুস্থ করে তোলা হয়েছিল। বাংলাদেশে কুষ্ঠরোগের চিকিৎসা শুরু হয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামের পর থেকে।
মৌলভীবাজার বন বিভাগের প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ এই মহাবিপন্ন চালমুগরা গাছটি চারার বিস্তার ঘটিয়ে এ প্রজাতিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন বলে জানান ল্যাপ্রসি প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর পরেশ দেবনাথ।
উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ও পরিবেশ বিষয়ক গবেষক ইশতিয়াক সোবহান বাংলানিউজকে বলেন, চালমুগরাকে সম্পূর্ণ বিদেশি গাছ বলা যাবে না। এটি ভারতের আসাম প্রদেশসহ অন্য অঞ্চলে রয়েছে। সেখান থেকে এনে হয়তো এটি লাউয়াছড়াতে রোপণ করা হয়েছিল। তৎকালীন ল্যাপ্রসি রোগ নিয়ে নানান কুসংস্কার ছিল। একে পাপের ফল হিসেবে গণ্য করা হতো। ল্যাপ্রসি রোগীকে ভয় পেয়ে সমাজচ্যুত করাসহ নির্বাসনে পাঠানো হতো। তখন সেই ল্যাপ্রসির একমাত্র ওষুধ হিসেবে চালমুগরা ছিল সমাদৃত। চায়নিজ ও ভারতীয় আয়ুর্বেদরা এটি ল্যাপ্রসির ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করতেন। ১৯০০ সালে ইউরোপিয়ানরাও এটি ব্যবহার করেছিলেন।
মৌলভীবাজার বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) তবিবুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, গতবছর থেকে চালমুগরার চারা আমরা উৎপন্ন করে চলেছি। আশা করা যায় এই চারাগুলোই বিপন্ন এ প্রজাতিকে প্রকৃতিতে বাঁচিয়ে রাখবে।
বাংলাদেশ সময়: ১১৩৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৬, ২০১৭
বিবিবি/এএ