সচেতন এলাকাবাসীর অভিযোগ, এই পরিবেশ-প্রকৃতি ধ্বংসে জড়িত স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনীতিক। নেপথ্যে আছে উপজেলা ও পুলিশ প্রশাসন।
অপরূপ জাফলং- কথাটি এখন অতীত। অনিয়মতান্ত্রিক ও অবৈধপন্থায় পাথর উত্তোলনের ফলে প্রকৃতির নিজস্বতা হারিয়েছে জাফলং। পাথরখেকোদের লালসায় পিয়াইন নদী হারিয়েছে গতিপথ। খোয়া গেছে নদীর তীর, রাস্তাঘাট, খেলার মাঠ। বাড়িঘর বিলীন করেও থেমে নেই ধ্বংসযজ্ঞ।
এবার পাথর খেকোদের রাক্ষসী থাবায় হারাতে বসেছে কান্দুবস্তি, নয়াবস্তি, জুমপাড় তথা খাসিয়াদের সংগ্রামপুঞ্জির সবুজায়নটুকুও। এখন কেবল এটুকুই ধ্বংসের বাকি। সরেজমিন এমন চিত্র দেখা গেছে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এমন ধ্বংসলীলা চালাতে এখন নামানো হয়েছে হাজার খানেক বোমা মেশিন। এসব মেশিন যেনো খাবলে খাচ্ছে জাফলংয়ের অবশিষ্ট বসতি এলাকা।
স্থানীয়রা বলেন, জোর যার, মুল্লুক তার। ওখানে আওয়ামী লীগ-বিএনপি একাট্টা। আওয়ামী লীগ-বিএনপি নেতারা মিলেমিশে শাসন করেন জাফলং। তারাই প্রশাসন সামলান। উপরের রাজনৈতিক নেতাদের দৈনিক ও সাপ্তাহিক হারে টাকা দিয়ে চালান বোমা মেশিন। এই টাকার ভাগ কোথায় না যায়? এমন উল্টো প্রশ্ন স্থানীয় এক বাসিন্দার।
স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, বোমা মেশিন দিনে বন্ধ থাকে, সচল হয় রাতে। মেশিনের শব্দে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে এলাকা। ঘরবাড়ি থরথর করে কাঁপতে থাকলেও কাঁপে না প্রশাসন। দানবের অবিরত শব্দে বিঘ্নিত শিশু কিশোরদের পড়ালেখার পরিবেশ। স্বাস্থ্য ঝুঁকি তো আছেই।
খোঁজ নিয়ে পাওয়া গেলো আরো চাঞ্চল্যকর তথ্য। বোমা মেশিন থেকে শুরু করে সব কিছুর শেল্টারদাতা স্থানীয় এমপির আশির্বাদে চালক থেকে রাতারাতি আওয়ামী লীগ নেতা বনে যাওয়া লিয়াকত আলী, বিএনপি নেতা ও জেলা পরিষদের সদস্য মোহাম্মদ শাহপরান, উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান শাহ আলম স্বপন।
বোমা মেশিন স্থাপিত এলাকাই নয়, পুরো জাফলং চলে তাদের হুকুমে। তাদের সঙ্গে আরেক নাম আলা উদ্দিন। যিনি লাইনম্যান হিসেবে এলাকায় অধিক পরিচিত। বোমা মেশিন থেকে টাকা তুলে বন্টন করার দায়িত্ব তার ওপরই ন্যস্ত।
শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বড় বড় লিডার ও প্রশাসনকে সামলে নেন ওই লাইনম্যান। দিন শেষে নেতাদের কাছেও তিনিই হিসাব দাখিল করেন। টাকার ভাগবাটোয়ারা পৌছান বিভিন্ন স্থানে।
এছাড়া স্থানীয়দের মধ্যে অর্ধশতাধিক পাথরখেকো চক্রের সদস্য বোমা মেশিন বসিয়ে পাথর উত্তোলন অব্যাহত রেখেছেন- এমন তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে কয়েকজনের নামও উঠে এসেছে স্থানীয় লোকমুখে।
তারা হলেন- বিল্লাল মিয়া, ঝিনুক, আবদুল্লাহ, ভান্ডারী, সামছু মিয়া, জামাই সুমন, ফারুক মিয়া, সেলিম আহমদ। তারা যে স্থানে বোমা মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলন করছেন ওই স্থানটি ব্যবসায়ী মিজান আজিজ সুইট ও মুকিত মিয়ার জায়গা বলে জানা গেছে।
তবে অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, স্থানীয় নেতাদের শক্তির সাথে পেরে না উঠে ওই দুটি স্থান সুইট ও মুকিত বিক্রি করে দিয়েছেন।
এ ব্যাপারে সিলেটের গোয়াইনঘাট থানার ওসি (তদন্ত) হিল্লোল রায় বাংলানিউজকে পুলিশের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করে বলেন, ‘উপজেলা প্রশাসন উদ্যোগ নিলে আমরা অভিযান চালাই। বোমা বেশিন ধ্বংসের ব্যাপারে কোনো অনিহা বা দায়িত্ব অবহেলা নেই। পুলিশ অভিযান চালালে বোমা মেশিন বন্ধ হয়ে যায়। চলে এলে আবারও শুরু হয়। তবে পুলিশকে ম্যানেজ করার বিষয়টি সঠিক নয়।
সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আজিজুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘বোমা মেশিন বন্ধে রাতেও অভিযান করেছি। মূলত; গ্রামের লোকজনও জড়িত। যে কারণে স্থানীয়ভাবে সহযোগিতা পাই না। তাই প্রশাসন আক্ষরিক অর্থে ‘হেল্পলেস’। আমাদের লোকজন, যাদের অভিযানে নিয়ে যাই, তারাই অভিযান চালাতে নিরুৎসাহিত করে। ভিলেজ সংরক্ষণ কমিটি সাহায্য করার কথা থাকলেও পাই না। বোমা মেশিন ভাঙার লেবার পাই না। পেলোডার ও বুলডোজারের মালিক এলাকার হওয়াতে তারা সাহায্য করে না। তাছাড়া প্রতিটি মানুষের বাড়িতে বোমা বেশিনের কিংবা পাথর উত্তোলনের যন্ত্রাংশ রয়েছে। ’
আমাদের বিবেক বিক্রি হয়ে গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘গ্রামের লোকজনই বোমা মেশিনের মালিক’।
তিনি বলেন, ‘অভিযান হওয়াতে উল্টো পত্রিকায় নিউজ করানো হয়, পাথর উত্তোলন না করার ফলে শ্রমিকরা মানবেতর জীবন-যাপন করছে। ওই কপি দেখিয়ে পাথর উত্তোলনের আদেশ এনে বোমা মেশিন চালানো হয়’।
তবে অবাধে বোমা মেশিন চললেও জেলা প্রশাসন বলছে ‘বোমা মেশিনের বিরুদ্ধে আমাদের শক্ত অবস্থান। বাস্তব চিত্রই যার প্রমাণ’।
এ ব্যাপারে সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শহিদুল ইসলাম চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, ‘বোমা বেশিন আমরা চলতে দেই না। তারা গোপনে চালাতে চায়, রাতের বেলা। বোমা মেশিনের বিরুদ্ধে আমাদের শক্ত অবস্থান আছে। দু’দিন পর পর অভিযান চালানো হয়। বোমা মেশিন বন্ধে মোটিভেশনও চলছে, অভিযানও চলছে’।
বাংলাদেশ সময়: ১০২৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩০, ২০১৭
এনইউ/জেডএম