আর্দ্রা তারার নাম অনুসারে নাম রাখা হয়েছে অগ্রহায়ণ মাসের। কার্তিকের পর আসে সর্বজনীন লৌকিক উৎসব নবান্ন।
ছবির মতো সুন্দর এ মাসটির আরেক নাম মার্গশীর্ষ। প্রাচীন বাংলা ভাষায় এই মাসটিকে আঘন নামেও চিহ্নিত করা হত। মৃগশিরা নামক তারা থেকে 'মার্গশীর্ষ' নাম এসেছে। তবে আমাদের কাছে অগ্রহায়ণ এখন বাংলা সালের অষ্টম মাস।
এক সময় অগ্রহায়ণ ছিল বছরের প্রথম মাস। 'অগ্র' শব্দের অর্থ 'আগে' আর 'হায়ণ' শব্দের অর্থ 'বছর'। বছরের আগে বা শুরুতে ছিল বলেই এই মাসের নাম 'অগ্রহায়ণ'। এটি হেমন্তের অন্যতম মাস।
"অগ্রহায়ণ" শব্দের অভিধানিক অর্থ বছরের যে সময় শ্রেষ্ঠ ব্রীহি (ধান) উৎপন্ন হয়। অতীতে এই সময় প্রচুর ধান উৎপাদিত হতো বলে এই মাসটিকেই বছরের প্রথম মাস ধরা হত। এখনও এ মাসের সঙ্গে রয়েছে ফসলের নিবিড় সম্পর্ক।
অগ্রহায়ণকে চলতি বাংলা ভাষায় আদর করে ডাকা হয় অঘ্রান। এ মাসটি লোকসংস্কৃতি ও বাংলার প্রকৃতিতে যেমন মিশে আছে, তেমনি স্মরণীয় হয়ে আছে আমাদের বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের চরণে। কবিগুরুর রচনায় আমাদের যে জাতীয় সংগীত, তাতে গীত হয়েছে সমবেত কণ্ঠে এই মোহনীয় লাইনটি: 'ও মা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি॥'
শ্বাশত বাংলায় অঘ্রানের ভরা ক্ষেতে এই হাসি হলো ফসলের উল্লাস। এই হাসি কৃষাণ-কৃষাণীর হৃদয়ের উচ্ছাস। মাতৃরূপী জন্মভূতির ভরা ক্ষেতে মধুর হাসি হয়ে দোলে উঠে আদিঅন্তহীন পাকা ধানের সোনালী আভা। যে সৌন্দর্য্যের সাথে একমাত্র মায়ের পবিত্রতম হাসির রয়েছে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক।
জাতীয় সংগীতের ছত্রে ছত্রে অঘ্রানসহ প্রকৃতির নানা অনুসঙ্গকে স্পর্শ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। তারপর গভীর বেদনায় বলেছেন, 'মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়নজলে ভাসি। ' শস্য ও সন্তানের ক্ষতিতে মায়ের মলিন চেহারা খুবই স্বাভাবিক। মায়ের কষ্ট দেখে প্রতিটি সন্তানই বেদনায় ভেসে যায়। অঘ্রানের উৎসব মুখরতার সময় আমরা যেন প্রকৃতি, পরিবেশ, মানুষকে ফলবন্ত ও সুন্দর করার কথাটিই সামনে রাখি, মা-মাটি-প্রকৃতি ও পরিবেশকে সজীব ও নিষ্কলুষ রাখি; প্রকৃতি ও মানুষের ক্ষতি করে মাতৃরূপী জন্মভূমির কষ্টের কারণ না হই।
হিন্দু সমাজের বিশ্বাস অনুযায়ী, অগ্রহায়ণ মাস বিয়ে-শাদির পক্ষে বিশেষ শুভ মাস। নবান্নে উৎসবে হিন্দু লোকসমাজে অগ্রহায়ণ মাসকে 'লক্ষ্মীর মাস' মনে করা হয়। এ কারণে এই মাসেই নবান্ন উৎসব ও লক্ষ্মীপূজার বিশেষ আয়োজন করা হয়।
হেমন্তের ফসল কাটাকে কেন্দ্র করেই নবান্ন উৎসবের সূচনা হয়। নবান্ন (অর্থ- নতুন অন্ন) বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শস্যোৎসব। নবান্ন হল নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে প্রস্তুত চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব, যা সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান পাকার পর এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের কোনো কোনো অঞ্চলে ফসল তোলার পরদিনই নতুন ধানের নতুন চালে ফিরনি-পায়েশ অথবা ক্ষীর তৈরি করে আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীর ঘরে ঘরে বিতরণ করা হয়। নবান্নে জামাইকে নিমন্ত্রণ করা হয়, মেয়েকেও বাপের বাড়িতে ‘নাইওর’ আনা হয়।
নবান্নে নানা ধরনের দেশীয় নৃত্য, গান, বাজনাসহ আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পালিত হয়। লাঠিখেলা, বাউলগান, নাগরদোলা, বাঁশি, শখের চুড়ি, খৈ, মোয়ার পসরা বসে গ্রাম্য মেলায়।
এক সময় বাংলায় বছর শুরু হতো হেমন্ত দিয়ে। কারণ, ধান উৎপাদনের ঋতু হলো এই হেমন্ত। বর্ষার শেষ দিকে বোনা আমন-আউশ শরতে বেড়ে ওঠে। আর হেমন্তের প্রথম মাস কার্তিকে ধান পরিপক্ক হয়। কাটতে হতো অগ্রহায়ণে।
প্রাণোচ্ছল এ মাসের কথা মনে রেখেই সম্ভবত বাংলার চিরায়ত গায়ক গেয়েছেন: আবার জমবে মেলা, বটতলা হাটখোলা। অগ্রাহয়ণে নবান্নে উৎসবে, সোনার বাংলা ভরে উঠবে সোনায়, বিশ্ব অবাক চেয়ে রবে। । আবার ফিরবে এসে বাংলার বন্দরে বেশাতির বড় বড় মহাজন। আবার খুঁজবে তারা সোনা ফলা বাংলার জহরত হীরা মনি কাঞ্চন। । পথে পথে প্রান্তরে ঘরে আঙ্গিনায়, গৌরবে ভরাবে সৌরভে। আবার আনবে ছিনে বিশ্বের সম্মান বাংলার কথা আর কবিতা। মুক্তির ইতিহাস, পৃথিবীর বিস্ময়, বাস্তব স্বপ্নের ছবিটা। । বাংলার গল্পে গানেরও কথায়, বিশ্বের আঙ্গিনা মূখর হবে। (কথা ও সুর: লোকমান হোসেন ফকির)
বাংলাদেশ সময়: ০৯০৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০১৭
এমপি/এসএইচ