ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

চরম ঝুঁকিতে হাওরের জীবন

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫২৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৬, ২০১৭
চরম ঝুঁকিতে হাওরের জীবন চরম ঝুঁকি-নিরাপত্তাহীনতায় বেসামাল হাওরের সাধারণ মানুষ। ছবি: রেজওয়ান আহাম্মেদ তৌফিক

কিশোরগঞ্জ থেকে: অথৈ পানিতে ছোট ছোট দ্বীপের মতো ভেসে থাকা হাওরাঞ্চলের গ্রামগুলো এখন চরম ঝুঁকিতে। নিরাপত্তাহীনতায়ও বেসামাল সেখানকার মানুষজন। প্রাকৃতিক বৈরিতা, যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা, বিদ্যুৎ ও অন্যান্য সুবিধার অভাবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিও।

চারিগ্রামে ফাইভ মার্ডারের ঘটনার পর আতঙ্ক আর উদ্বেগ গ্রাস করেছে সমগ্র হাওরাঞ্চলকে।

দিনে-দুপুরে চারিগ্রামে দুই দলের সংঘর্ষে পাঁচজন নিহত ও অর্ধশতাধিক মানুষ আহত হওয়ার ঘটনায় উভয়পক্ষের মামলায় আসামি করা হয়েছে প্রায় ২৫০ জনকে।

‘আমাদের গ্রামে এখন আর কোনো পুরুষ নেই, পুরো এলাকাই পুরুষশূন্য। মামলায় গ্রেফতার এড়াতে গা-ঢাকা দিয়েছে লোকজন’- এভাবেই পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন কিশোরগঞ্জ শহরের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শাওন শাহরিয়ার।

বাংলানিউজকে শাওন বলেন, ‘হাওরের মানুষ এখন জীবনের নিরাপত্তার বিষয়েই বেশি চিন্তিত। অতিবৃষ্টি বা বন্যার মতো দুযোগের চেয়ে আইন-শৃঙ্খলাজনিত সমস্যা বেশি ভাবাচ্ছে তাদেরকে’।

কিশোরগঞ্জের পূ্র্বাঞ্চলীয় ইটনা, মিটামন, অষ্টগ্রাম উপজেলা নিয়ে গঠিত বিস্তীর্ণ ও দুর্গম হাওরাঞ্চল জেলার মোট আয়তনের প্রায় তিনভাগের একভাগ হলেও প্রশাসনিক সুযোগ-সুবিধা সেখানে অপ্রতুল। নাগরিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাও জোরদার নয়। শত শত মানুষ দিনের বেলায় প্রকাশ্য লড়াই করে নিজেদের মধ্যে খুন-জখম করলেও সেটি ফেরাতে পারেননি আইন-শৃঙ্খলায় নিয়োজিতরা।

প্রাকৃতিক সম্পদ, প্রাণবৈচিত্র্য ও পর্যটন সম্ভাবনার হাওরাঞ্চলের সমৃদ্ধি নষ্ট হচ্ছে নাগরিক নিরাপত্তাহীনতায়।  ছবি: রেজওয়ান আহাম্মেদ তৌফিকবিভিন্ন শ্রেণি-পেশার হাওরবাসী বলছেন, ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিরূপ পরিবেশের প্রতিকূল জীবনের পাশাপাশি নাগরিক নিরাপত্তাহীনতা, সামাজিক সুরক্ষার অভাব ও আইন-শৃঙ্খলার অবনতি বেড়ে দুর্বিষহ হয়ে উঠছে হাওরের জীবন-যাপন। প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ, প্রাণবৈচিত্র্য ও পর্যটন সম্ভাবনার হাওরাঞ্চলের উন্নয়ন-অগ্রগতি, আধুনিকায়ন ও সমৃদ্ধি বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে।

ইটনার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অপরেশ তলাপাত্র বলেন, ‘বিচ্ছিন্ন গ্রামগুলোতে নৌ-পথে দ্রুত যাতায়াতে যথেষ্ট সংখ্যক আধুনিক নৌ-যান পুলিশের নেই। মান্ধাতার আমলের নৌকা দিয়ে পুরো হাওরাঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও অসম্ভব’।

‘শুধু আইন-শৃঙ্খলাজনিত নিরাপত্তাহীনতাই নয়, চিকিৎসা ও অন্যান্য প্রয়োজনে যাতায়াতেও মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই’- বলেন অষ্টগ্রামের উন্নয়নকর্মী শাহান আরা শিউলি।

তিনি বলেন, ‘দিনে যদিও কিছু একটা ব্যবস্থা করা যায়, রাতের অন্ধকারে মাইলের পর মাইল জলপথ পাড়ি দেওয়া মোটেও সম্ভব হয় না। চরম নিরাপত্তাহীনতা ও ঝুঁকির মধ্যেই বিপদ মাথায় নিয়ে মানুষকে জীবন কাটাতে হচ্ছে হাওরে’।

‘হাওরের প্রেক্ষাপটে যোগাযোগ সমস্যা ও বিচ্ছিন্নতার কারণে খুন-খারাবি ও আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা বেশি হয়ে থাকে। নির্বিঘ্নে অপরাধ করে চলে গেলেও তা ঠেকানো যাচ্ছে না বা সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত হয়েও অপরাধীকে ধরা যাচ্ছে না। সামাজিক সংহতি ও নাগরিকদের প্রচেষ্টা বাড়ানো না গেলে কেবলমাত্র প্রশাসনের ভরসায় হাওরাঞ্চলের নিরাপত্তা ঝুঁকি কমানো সম্ভব হবে না’ বলে মনে করেন রাজনীতিবিদ অ্যাডভোকেট ভূপেন্দ্র ভৌমিক দোলন।

আইনজীবী নাসিরউদ্দিন ফারুকী বলেন- ‘জেলার অন্যান্য এলাকার চেয়ে হাওরে মামলা-মোকদ্দমার সংখ্যা বেশি। জমি-জমা নিয়ে দেওয়ানি মামলার মতো মার-দাঙ্গাজনিত অপরাধের ফৌজদারি মামলাও বেশি হারে রয়েছে। এমন অনেক তুচ্ছ বা মামুলি বিষয়েও মামলা হচ্ছে, সামাজিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে যেগুলোর মীমাংসা সম্ভব’।

তারা সকলেই মনে করছেন, ‘হাওরাঞ্চলের মানুষের চরম ঝুঁকির জীবনকে শান্তি ও নিরাপত্তা দিয়ে সুরক্ষিত করতে না পারলে সামাজিক চাপা ক্ষোভ ও অশান্তি থামবে না। এজন্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব, প্রশাসন ও শিক্ষা বা সামাজিক ক্ষেত্রে কর্মরত ব্যক্তি ও সংস্থাকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে কমিউনিটি ভিত্তিক নিরাপত্তা, সংঘাত নিরসন ও উত্তেজনা প্রশমনের কাজে’।

বাংলাদেশ সময়: ১১২০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৬, ২০১৭
এমপি/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।