চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রফেসর ড. ইরশাদ কামাল খান বাংলানিউজকে বলেন, দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রাচীন দেয়াঙ পরগণার আশেপাশে 'লেগ হর্ন' ধরনের এই মোরগ প্রচুর দেখা যেতো। ইংরেজিতে এগুলোকে 'দেয়াঙ ফাউল' বলা হতো।
মোরগগুলোকে কেন 'আছিল' নামকরণ করা হয়েছে, তা নিয়েও চমৎকার ঐতিহাসিক তথ্য জানা যায়। মূলত কালের বিবর্তনে 'ইয়াসিন' থেকে 'আছিল' শব্দটি মোরগগুলোর সঙ্গে জুড়ে গেছে বলে ধারণা করা হয়।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় মোরগকে 'কুরা' বলা হয়। অবশ্য 'কুরা' উচ্চারণের সঙ্গে স্থানীয় টান দিয়ে কথাটি বলা হয়। ঠিক লেখার 'কুরা' নয় উচ্চারণটি। একটু ভিন্ন রকমের।
দেয়াঙ পাহাড়ের 'ইয়াছিন কুরা' প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের ইতিহাস গবেষক জামাল উদ্দিন বাংলানিউজকে জানান, সাদা মোরগ নামে পরিচিত বৃহদকায় একশ্রেণীর পক্ষিকুলের প্রজনন ছিল দেয়াঙ পাহাড়ে। দেশীয় মোরগ-মুরগির চেয়ে ৫-৭ গুণ বড়ো আকারের এই মোরগের দীর্ঘ পা ও গলা দেখতে অনেকটা ময়ূর আকৃতির ছিল। ধারণা করা হয়, প্রাচীন দেয়াঙ বন্দরের সাথে দশম শতাব্দীর দিকে আরব্য ব্যবসায়ীদের সাগর পথে জাহাজযোগে ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল। এসব আরব্য ব্যবসায়ীর সঙ্গে অনেক পীর আউলিয়া ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে দেয়াঙে আসেন। হযরত শাহ মোহছেন আউলিয়া (রাঃ) তাদের অন্যতম। বটতলী গ্রামে তাঁর মাজার হয়েছে।
তিনি বলেন, হয়তো ঐ সময় আরব্য বণিকেরাই ‘সাদা মোরগ’ নামের এই বৃহৎ আকারের পাখিটি দেয়াঙে আনেন এবং প্রজনন করান। ধবধবে সাদা অপূর্ব সুন্দর এই সাদা মোরগ দেয়াঙবাসী লালন পালন শুরু করলে ক্রমশ তার বংশবৃদ্ধি ঘটে সমগ্র চট্টগ্রামে ছড়িয়ে যায়।
এবং আঞ্চলিক ভাষায় অন্য এক নাম ‘ইয়াছিন কুরা' নামে ডাকা হয়।
কেন 'ইয়াসিন কুরা' তা ব্যাখ্যা করে জামাল উদ্দিন বলেন, মুঘল শাসনামল থেকে এই মোরগটি ‘ইয়াছিন কুরা' নামেই পরিচিতি লাভ করে। তার কারণ হিসেবে জানা যায়, নবাবী আমলে চট্টগ্রামের শাসনকর্তা ছিলেন নবাব ইয়াছিন খাঁ (১৭১৯-১৭২৬)। তাঁরই উদ্যোগে দেয়াঙ পাহাড়ে সরকারিভাবে বিশাল আকারের একটি পাখির খামার প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ঐ খামারের অন্যান্য পাখির সাথে ব্যাপকভাবে ‘সাদা মোরগের’ প্রজনন শুরু হয় সরকারিভাবে। নবাব ইয়াছিন খাঁ’র বেশ প্রিয় ছিল খামারের ঐ সাদামোরগটি। এক পর্যায়ে মোরগটির নামকরণ হয়ে যায় চট্টগ্রামী ভাষায় ‘ইয়াছিন কুরা।
পর্যটক ও বিভিন্ন দেশ থেকে আগত ব্যবসায়ীদের কাছে ‘ইয়াছিন কুরা' নামক এই পাখিটি বেশ আকর্ষণীয় ছিল। প্রায় ৪/৫ কেজি ওজনের মাংসল সুস্বাদু এ 'ইয়াছিন কুরা’ নামক মোরগের কদর ছিল সর্বমহলে। দেয়াঙ তথা আনোয়ারা পশ্চিম পটিয়ার বাসিন্দা ছাড়াও চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলের গৃহস্থ পরিবারে এই মোরগটি পালিত হতো সেই আদিকাল থেকে।
লোকশ্রুতিতে জানা যায়, এই মোরগটির বিশেষ গুরুত্ব ছিল হযরত শাহ মোহছেন আউলিয়া (রাঃ)’র মাজারে মানত করা। প্রতি বছর ওরশ উপলক্ষে এই মোরগটি অতিমাত্রায় মানত করা হতো এবং জবাই করে খাওয়া হতো।
শত শত বছর ধরে ঝাঁকে ঝাঁকে ইয়াছিন কুরা নামক এই মোরগ চট্টগ্রামের গ্রামীণ পরিবারের ঘরে ঘরে পালিত হলেও বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় ধরে তার সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে কোনো এক অজানা মহামারিতে ‘ইয়াছিন কুরার’ বংশ হ্রাস প্রাপ্ত হয়ে যায় চট্টগ্রাম থেকে। যার অবশিষ্ট চট্টগ্রামের কোথাও আছে কিনা সেটাও বলা যাচ্ছে না। প্রাণি সম্পদ বিভাগও এ ব্যাপারে বিশেষ কিছু জানে বলে নিশ্চিত হওয়া যায় না। মাঝে মাঝে প্রবীণদের স্মৃতিচারণে ভেসে আসে এই বিচিত্র প্রজাতির মোরগের নানা কথা।
সবার চোখের সামনে দিয়ে এমন সুন্দর মোরগ হারিয়ে বিলুপ্তির পথে চলে গেলেও কিছুই করা যাচ্ছে না। মুঘল আমলে খামার করে যে প্রাণীকে বিকশিত করা হয়েছিল, এই আধুনিক বিজ্ঞানের আমলে আমরা সেটিকে রক্ষা করতে পারছি না! এর চেয়ে দুঃখজনক বিষয় আর কি হতে পারে?
বাংলাদেশ সময়: ১২৪০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৩, ২০১৭
এমপি/জেডএম
ক্যাপশন