ঢাকা, শনিবার, ২৪ কার্তিক ১৪৩১, ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

ব্রহ্মপুত্রের চরের জীবন

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৮, ২০১৭
ব্রহ্মপুত্রের চরের জীবন ব্রহ্মপুত্র। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের পুরো শরীর জুড়ে আছে শত শত নদী আর নদীর বুকে জেগে থাকা চর। বিচিত্র এসব চরের জীবন। মানুষ, সমাজ, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, সবই অন্য রকম চরের ভূগোলে। চর যেন নাগরিক সাধারণ জীবনের বাইরের এক অন্য জগত।

দক্ষিণ-পূর্ব ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কিছু পার্বত্য এলাকা ছাড়া অবশিষ্ট বাংলাদেশ বিশ্বের বৃহত্তম নদীগঠিত বদ্বীপ। তিনটি বড় নদী গঙ্গা/পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র/যমুনা ও মেঘনা/গাঙ্গেয়-ব্রহ্মপুত্র গঠন করেছে এই বদ্বীপ, যা আসলে একটি বৃহদাকার চর।



বাংলাদেশের তিন প্রধান নদনদী উত্তরের হিমালয়  থেকে দক্ষিণের বঙ্গপোসাগর অবধি তাদের সর্পিল প্রবাহপথে প্রতিবছর কোটি কোটি টন বালি ও কাদা বয়ে নিয়ে আসে। প্রাকৃতিকভাবে প্রবাহিত বালি-কাদার সিংহভাগ দিয়ে নদ-নদীর বক্ষদেশ ক্রমেই উঁচু হয়ে ওঠে, আর তাদের সঙ্গমস্থল বা মোহনার মুখে জেগে ওঠে নানা আকৃতির চর।

চরে যে ভূমি গঠিত হয়, তার সাথে পয়স্তি ও শিকস্তি (Alluvion and Diluvion), এই শব্দদ্বয় জড়িত। উপমহাদেশের প্রবল বর্ষার তীব্র জলপ্রবাহ স্ফীত ও অগভীর নদীখাত বরাবর সরাসরি সাগরে পতিত হতে না পেরে নদ-নদীর উভয় তীর ছাপিয়ে বিস্তীর্ণ এলাকার জমি যেমন প্লাবিত করে, তেমনি নদীর পাড় এলাকার বিশাল ভূমিখণ্ডও গ্রাস করে। এই প্রক্রিয়ায় নদীর একদিকে যখন ভাঙ্গন চলে, অন্যদিকে তখন অলক্ষ্যে নতুন ভূখণ্ড গঠিত হয়। এ ধরনের নদীভাঙ্গা (diluvion) ও চর জেগে-ওঠা (alluvion) হলো নদীর নিয়ত প্রক্রিয়া। আর এই ভূমিগঠন প্রক্রিয়া থেকে চরজমির মালিকানার অধিকার ও নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত কিছু প্রয়োগবিধি ও প্রথা গড়ে উঠেছে।

ব্রহ্মপুত্রের ভাঙ্গন।  ছবি: সংগৃহীত পয়স্তি জমি জোর করে নিয়ন্ত্রণে নেওয়া ও রাখার কাজ সাধারণভাবে চরদখল নামে অভিহিত। সরকারি প্রশাসনের কোনরকম অনুমতি বা মঞ্জুরি ছাড়াই মূল অবস্থানে পুনর্গঠিত জমি পুনর্দখল করার অবাধ অধিকার একজন শিকস্তি জমিমালিকের রয়েছে। একইভাবে নদী-তীরবর্তী মালিক নতুন চরের জমি দখলে নেওয়ারও অধিকারী যদি ওই নতুন চর ধীরে ক্রমান্বয়ে তার জমির সাথে লাগোয়া আকারে গড়ে ওঠে। এক্ষেত্রে তার একটি মাত্র দায়িত্ব রয়েছে, আর সেটি হলো কর বা খাজনা প্রদান করা। সম্পত্তিতে এই রদ-অযোগ্য অধিকারের ভিত্তি সার্বজনীন আইন ও ন্যায়বিচারের বুনিয়াদে প্রতিষ্ঠিত বলে উল্লেখ করা হয়ে থাকে।

এ কারণেই সামন্ত ও অন্যান্য জোতের স্বত্বাধিকারীরা যখন যেখানে নতুন চর জেগেছে সেগুলি বলপ্রয়োগে গ্রাস করতে উৎসাহিত হয়েছে। তারা সুযোগ ও পরিস্থিতি অনুযায়ী ঐ চরের জমিকে মূল অবস্থানে পুনর্গঠিত শিকস্তি জমি অথবা জমিসংলগ্ন বিবৃদ্ধি হিসেবে দাবি করেছেন। অবশ্য প্রতিপক্ষের তরফ থেকে একই ধরনের দাবি উত্থাপিত হয়ে থাকে।

নতুন চরের জমি অত্যন্ত উর্বর, তা থেকে বেশ মোটা সালামি ও নতুন খাজনা পাওয়া যাবে, বিধায় এর অনিবার্য ফল হিসেবে চর দখলে সহিংসতা প্রয়োগ করা হয়। এর ফলে দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও খুনাখুনি ঘটে। এ ধরনের চরের জমি আগেভাগে দখলে নেওয়ার স্পষ্টতই সরেজমিনে তো বটেই, এমনকি, আইন আদালতেও একটি সুবিধা পাওয়া যায়। তাই এক বা অন্য তরফের অনুকূলে আইনে যা কিছুই ভালমন্দ থাকুক না কেন, কার্যত পেশিশক্তি চর শাসন করে।

অতীতে এ ধরনের পরিস্থিতি বিরাজমান থাকার কারণে কর্তৃপক্ষ ১৯২০ সালে বঙ্গীয় পলিগঠিত ভূমি আইন পাস করে। এর উদ্দেশ্য ছিল পয়স্তি কিংবা সাগরের নিকটবর্তী কোন নদী মজে যাওয়ার কারণে যেসব জমি গড়ে ওঠে সেসব জমির দখল-সংক্রান্ত বিরোধ নিবারণ করা।

বাংলাদেশে বহু জনপদ চর থেকে গড়ে উঠেছে। বড় বড় নদীতে ও সমুদ্র মোহনায় অসংখ্য চর জনবসতিতে ভরপুর। এশিয়ার এই অংশের বৃহৎ নদ ব্রহ্মপুত্রে রয়েছে বহু চর। এর মাঝে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অাসমের প্রসিদ্ধ চরভূমি মাজুলিকে অনেকে বলেন, তেপান্তরেরও ওপারের দেশ। ৮৮০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের মাজুলি বিশ্বের বৃহত্তম নদী দ্বীপ।

অনেকগুলো গবেষণা গ্রন্থে ব্রহ্মপুত্র নদের বারোশোর বেশি চরভূমির কথা বলা হয়েছে। চরগুলো যত না ভৌগোলিক দূরত্বের ইঙ্গিতবাহী, তার চেয়ে বেশি মানসিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবধানের।

ব্রহ্মপুত্রের চরে।  ছবি: সংগৃহীত সামাজিক জীবনের সমীক্ষা মতে, প্রতিটি নদীর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী সম্পর্কে জড়িয়ে থাকা চরের ওঠাপড়া ও ভাঙাগড়া নিয়ে তৈরি হয় অস্তিত্ব-অনস্তিত্বের জটিল কার্যক্রম। ভূবিজ্ঞান বলে, পৃথিবীর অধিকাংশ চরই সতত বিপন্ন। অথচ নানা অনিবার্য তাগিদে মানুষ বিপদ উপেক্ষা করেই চরে বাসা বাঁধে। নিছক ভৌগোলিক পরিসরের তক্‌মা ঝেড়ে ফেলে চরও হয়ে ওঠে মানবিক পরিসর। কিন্তু বাস্তবে চর মানেই এক অপ-ভূমি, আক্রান্ত ও সঙ্কুল জনপদ। চর যদি হয় শক্তিশালী ব্রহ্মপুত্র নদের জটিল এবং সতত পরিবর্তনশীল ব-দ্বীপ শৃঙ্খলার অংশ, তা হলে তো কথাই নেই।

ভূতাত্ত্বিকরা বলেন, ষোড়শ, সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতাব্দীতে হয় বন্যা আর না হয় ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় এই ব-দ্বীপ শৃঙ্খলার স্থিতিকে দুর্বল করে দিয়েছিল। আড়াইশ’ বছর পরে ১৯৫০ সালে এল প্রচণ্ড ভূমিকম্পের আঘাত। এইসব বিপর্যয়ের প্রকোপে বারবার নদীখাতে পরিবর্তন এসেছে। ফলে কয়েকশ’ বছর ধরেই প্রতি মুহূর্তে এখানে চলছে চর ভাঙা-গড়ার খেলা।

ফলে পাহাড়ি অঞ্চল ছেড়ে, দেশের মধ্যের উঁচু জমি ছেড়ে, জন্মভূমি, কর্মভূমি ছেড়ে ব্রহ্মপুত্রের নানান চরে বাসা বেঁধেছেন বহু মানুষ। কেউ এসেছেন পুরনো বাসভূমির জীবিকা হারিয়ে, কেউ রাজরোষ থেকে বাঁচতে, কেউ দারিদ্র থেকে মুক্তির আশায়। অচিরেই তাঁরা বুঝেছেন, চরভূমি আসলে এক না-দেশ, নেই-এর রাজ্য। চরের আর্থ-সামাজিক, সাম্প্রদায়িক এবং রাজনৈতিক সমস্যাগুলো অর্থনৈতিক জীবনকেও বিপণ্ন করছে প্রতিনিয়ত। এছাড়াও রয়েছে চরবাসীর জাতিগত, ধর্মীয় এবং ভাষাগত পরিচিতি নিয়ে সমস্যা, নাগরিক অধিকার বা অধিকারহীনতা, স্থানীয় বাসিন্দা বনাম অভিবাসী মানুষদের দ্বন্দ্ব, রাজনীতির কূটকচালিতে বাসস্থান আর জীবিকার সমস্যা।

আসামের ব্রহ্মপুত্রের চরে স্থানীয় বাসিন্দা বনাম অভিবাসী মানুষদের দ্বন্দ্ব প্রায় সর্বত্রই প্রবলভাবে আছে। নতুন চর দেখে পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর দক্ষিণ সব দিক থেকেই নানা জাতি নানা ভাষা নানা ধর্মের মানুষ এসে ব্রহ্মপুত্রে বসতি স্থাপন করেছে। সপ্তম শতাব্দীতে শুরু হওয়া এই অভিবাসন প্রক্রিয়া দ্বাদশ শতাব্দী থেকে গতি পেয়েছে। ষোড়শ শতক থেকে বিভিন্ন অর্থনৈতিক কারণে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা হয়ে উঠেছে অভিবাসীদের এক অভীষ্ট গন্তব্য।

উনিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত অভিবাসীদের সঙ্গে স্থানীয় মানুষদের ছিল পারস্পরিক নির্ভরতার ভিত্তিতে অবৈরিতার সম্পর্ক। এক ধরনের সমন্বয় প্রক্রিয়াও চলছিল এই সময় জুড়ে। কিন্তু ১৮২৬ সালে ব্রিটিশরা অহোম রাজকে পরাস্ত করে অাসামে নিজেদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার পর থেকে এই ভূমিতে বসবাসকারী নানা সম্প্রদায়ের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে জটিলতা তৈরি হতে শুরু করল। তার একটা বড় কারণ অর্থনৈতিক।

বিশ্বের বৃহত্তম নদী দ্বীপ মাজুলি।  ব্রহ্মপুত্রের সুফলা উপত্যকায় আস্তে আস্তে নানা ধরনের ব্যবসায়িক পণ্যের চাষ আর জঙ্গল পরিষ্কার করে কাঠের ব্যবসা শুরু হল। শুরু হল বিভিন্ন ধরনের কারিগরি কর্ম। এই সব কাজে স্থানীয় মানুষদের আগ্রহ আর দক্ষতার অভাবে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শ্রমিক আনার ঠিকাদারি ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠল। আর কৃষির ভরকেন্দ্র ব্রহ্মপুত্রের মূল উপত্যকা থেকে সরে গেল অসংখ্য চরভূমিতে। তারই প্রতিফলন ঘটল প্রশাসনিক আর সামাজিক পরিচিতিতে নতুন নতুন শব্দের আমদানিতে, যেমন চরুয়া, পমুয়া, ময়মনসিঙিয়া, উজানিয়া, ভাইট্ট্যা ইত্যাদি।

বিশ শতকে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বসবাসকারী বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে এক ধরনের অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার সম্পর্ক তৈরি হল। পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর ছায়া ফেলতে লাগল অবিশ্বাসের কালো মেঘ। আরও একগুচ্ছ নতুন শব্দবন্ধ তৈরি হল— বহিরাগত, অস্থাবীয়, মিঞা। এর পাশাপাশি চলতে লাগল তৎকালীন  সরকারের নানা ধরনের প্রশাসনিক পদক্ষেপ। দুটি উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থা ছিল জনজাতি গোষ্ঠীর জন্যে সংরক্ষিত এলাকা, আর লাইন প্রথা। এই সব ব্যবস্থায় সমস্যা নিরসনের চেয়ে তার জটিলতাই বরং অনেকটা বেড়েছে।

এর ফলে কখনো শুরু হয়ে গেছে গোষ্ঠীগত আন্দোলন, সংঘাত, সংঘর্ষ এবং রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব। এই অস্থির সময়ের অবদান গভীর রাজনৈতিক ব্যঞ্জনায় পুষ্ট তিনটি শব্দ—অনুপ্রবেশকারী, বিদেশি আর সন্দেহজনক ভোটার। এই শব্দ তিনটিকে ঘিরে কত না রাজনৈতিক ধুন্ধুমারের ঘটনা ঘটেছে! এই তিনটি অভিধায় চিহ্নিত মানুষের অধিকাংশই এখন ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার চরবাসী, এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সর্ব অর্থেই প্রান্তিক, নিপীড়িত। আসলে চরের জীবন পৃথিবীর সবখানেই বিপজ্জনক, অস্থির, গোলমেলে ও সংঘাতময়। মানুষের সামাজিক জীবনের বিচিত্র রসায়নে চরের আর্থ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবন হয়ে আছে এক অন্য রকম জগতের মতো।

বাংলাদেশ সময়: ২০৩৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৮, ২০১৭
এমপি/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।