মঙ্গলবার (২৩ জানুয়ারি) বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জে লোকালয়ে এসে হামলা চালানোর পর একটি রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে পিটিয়ে হত্যা করেন স্থানীয়রা। বাঘের হামলায় গুলিশাখালী গ্রামের ছয়জন আহত হন।
ওইদিন সকালে গ্রামের টুকু ছেলে মাসুমকে নিয়ে জমির ধান কাটতে গেলে ধানক্ষেতে লুকিয়ে থাকা বাঘ মাসুমকে আক্রমণ করে। টুকু দলালের চিৎকারে গ্রামবাসী ছুটে এসে বাঘের মুখ থেকে মাসুমকে উদ্ধার করেন। এসময় বাঘের আক্রমণে আরও পাঁচজন আহত হন। একই দিন রাতেও আরেকটি বাঘ হানা দেওয়ার খবর পাওয়া যায়।
এর আগে ১১ জানুয়ারি সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের মোংলা উপজেলার বৈদ্যমারী গ্রামে বাঘ হানা দিয়ে একটি গরু মেরে ফেলে। ২০১৭ সালের ১৪ জুলাই নদী পার হয়ে সুন্দরবন থেকে সাতক্ষীরার শ্যামনগরের লোকালয়ে একটি বাঘ ঢুকে পড়ে। তিন ঘণ্টা টেংরাখালি গ্রামে অবস্থান করে ছাগল ধরার ব্যর্থ চেষ্টা করে ফিরে যায় বনে।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, বাঘের স্বভাব একবার লোকালয়ে এলে বারবার আসা। এসব বাঘ লোকালয়ে এসে মানুষ ও পশুর উপর হামলা চালায়। যে কারণে বাঘ লোকালয় ঢোকায় তারা শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।
বাঘ লোকালয়ে চলে আসার পিছনে বাঘ ও বন বিশেষজ্ঞরা বাংলানিউজের কাছে বেশ কিছু কারণ উল্লেখ করেছেন।
কারণগুলো হলো- বনে বাঘের প্রয়োজনীয় খাদ্যের অভাব, বাঘের খাদ্যাভাব হওয়ায় মানুষ খাওয়ার চিন্তা থেকে লোকালয়ে প্রবেশ করছে, সুন্দরবন সংলগ্ন নদী ও খাল ভরাট হওয়ায় বাঘ সহজেই লোকালয়ে প্রবেশ করতে পারছে, কুয়াশার কারণে শীতে বিড়াল জাতীয় প্রাণীরা দিক হারিয়ে লোকালয়ে আসে, বয়োবৃদ্ধ বাঘ শিকারের সক্ষমতা হারিয়ে লোকালয়ে আসতে পারে, বনে লবণাক্ততা বৃদ্ধি এবং অবৈধ শিকারিদের হামলায় প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে লোকালয়ে ঢুকছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দিন দিন কমে যাচ্ছে সুন্দরবনের আয়তন।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মদিনুল আহসানের দেওয়া তথ্যমতে, ২০০৮ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত পিটিয়ে হত্যাসহ নানাভাবে মোট ৯টি বাঘ মারা গেছে। এর মধ্যে ২০০৮ সালে ১টি, ২০০৯ সালে ২টি, ২০১০ সালে ২টি, ২০১১ সালে ১টি, ২০১২ সালে ২টি বাঘ মারা যায়। ২০১৩ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত কোনো বাঘ মারা যায়নি। ২০১৮ সালে এসে ১টি বাঘ পিটিয়ে মারা হলো।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিন প্রধান অধ্যাপক ড. মো. এনামুল কবির বাংলানিউজকে বলেন, বনে একটি খাদ্যচক্র থাকে। সেখানে বড় প্রাণী তার থেকে ছোট প্রাণী খায়, সে আবার তার থেকে ছোট প্রাণী খায়। যখন তাদের জঙ্গলে খাবার অভাব হয় তখন তারা অন্য খাবারের কথা ভাবে। সাধারণত বাঘের ভিতরে মানুষ খাওয়া আচরণ তৈরি হয়। ওরা তো সাধারণত হরিণ খায়। এক সময় শুকর খেতো। অন্য যেসব প্রাণী আছে সেগুলো খেতো। বাঘের খাদ্যাভাব হওয়ায় মানুষ খাওয়ার চিন্তা থেকে লোকালয়ে প্রবেশ করেছে। খাবার খুঁজতে খুঁজতে তারা বনের বাইরে চলে আসছে। সব বাঘ কিন্তু আসে না, শুধু যাদের মানুষ খাওয়ার আচরণ তৈরি হয় তারা আসে।
তিনি আরও বলেন, এখন তো কুয়াশা পড়ে। এতে বিড়াল জাতীয় প্রাণীরা দিক হারিয়ে ফেলে। যেটা ওদের একটি আচরণ। লোকলয়ে আসার সেটাও একটি কারণ হতে পারে। হয়তো জঙ্গল থেকে বের হয়ে গেছে আর ঠিক সময় ফিরতে পারছে না। এছাড়া শীতের সময় নদীর পানি কমে যায়। যখন ভাটা হচ্ছে তখন নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। এতে বাঘ সহজে নদী পার হয়ে যায়।
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মাহমুদুল হাসান বাংলানিউজকে বলেন, ক্যামেরা পদ্ধতিতে সুন্দরবনের বাঘ গণনা জরিপ-২০১৫-এর ফলাফল অনুযায়ী বাঘের সংখ্যা ছিল ১০৬টি। যার একটি পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। যা অত্যন্ত দুঃখজনক। মঙ্গলবার (২৩ জানুয়ারি) যে বাঘটি পিটিয়ে মারা হয়েছে সে ৬ জন মানুষকে আহত করেছে। ভোলা নদী ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে ভাটার সময় নদী শুকনো থাকায় বাঘটি লোকালয়ে ঢুকে পড়ে।
সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বাংলানিউজকে বলেন, সুন্দরবনে এখন বাঘের জন্য একটি প্রতিকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে গেছে। তার খাদ্যাভাব, পানির অভাব সব কিছু মিলেই প্রতিকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এমনিতে তো আর বাঘ বন থেকে আসে না।
তিনি বলেন, রয়েল বেঙ্গল টাইগারের দিন দিন সংখ্যা কমছে। এজন্য দায়ী চোরা শিকারি-জলবায়ু ও সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাব। বাঘের চামড়া পাচার ও উচ্চমূল্যে বিক্রির উদ্দেশ্যে চোরা শিকারিরা নির্বিচারে একের পর এক সুন্দরবনের বাঘ মেরে ফেলছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সুন্দরবনের বৈরী পরিবেশ বাঘের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে।
তিনি অভিযোগ করেন, বন বিভাগের উদাসীনতায় বাঘসহ বন্যপ্রাণীর নিরাপদ ও উপযুক্ত আবাসস্থল নিশ্চিত করা যাচ্ছে না বলেই বাঘের এ অবস্থা।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৫৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৬, ২০১৮
এমআরএম/এএ