ঢাকা, শনিবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

গাবুরার নিত্যসহচর দুর্যোগ

আশরাফুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০১১
গাবুরার নিত্যসহচর দুর্যোগ

শ্যামনগর থেকে ফিরে: সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার সর্বদক্ষিণের জনপদ গাবুরা। কপোতাক্ষ, খোলপেটুয়া ও চৌদ্দরশি নদী অববাহিকায় অবস্থিত উপকূলবর্তী গাবুরা।

এর দক্ষিণে সুন্দরবন। দুর্যোগ এ জনপদের নিত্যসহচর ।

প্রলয়ংকরী ঘূর্নিঝড় এদের নিত্যসঙ্গী। সুন্দরবনের বাঘ, কুমিরসহ বন্যপ্রাণী ও জলদস্যুদের অত্যাচার আর সাম্প্রতিক সময়ে লবনাক্ততার সঙ্গে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকা গাবুরার মানুষদের দেখলে সতিই বিস্ময় লাগে।

চারপাশে নদীঘেরা শ্যামনগরের দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরার আয়তন প্রায় ২৭ বর্গকিলোমিটার। অতীতে বেশ কয়েকবার ঘটে যাওয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটেছে এই জনপদে।

মাত্র কয়েক বছর পূর্বে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ঘূর্নিঝড় সিডর ও আইলায় একরকম পুরোপুরিই বিধ্বস্ত করে দেয় গাবুরাকে। সিডরে প্রাণ হারায় গাবুরার ৭০ বাসিন্দা। সিডর আর আইলায় বাঁধ উপচে ঢুকে পড়া লবন পানি তীব্র সংকট তৈরী করেছে কৃষি প্রধান এই এলাকাটিতে।

কার্যত এখানে বর্তমানে কোন কৃষিকাজ সম্ভব হচ্ছে না। গাবুরাবাসী কৃষিজীবী। লবন পানি ঢুকে পড়াছ কৃষিক্ষেত্র বিরাণ ভূমিতে পরিণত হছেয়ে। এতে বেকার হয়ে পড়েছেন ৩৮ হাজার  ৪শ’ পরিবারের সিংহভাগ মানুষ। বিত্তবানদের কেউ কেউ লবন চাষ করে টিকে থাকলেও চরম দুর্বিষহ জীবন পার করছেন বিপুল সংখ্যক প্রান্তিক মানুষ। লবন পানির কারণে কৃষি ব্যবস্থার বিপর্যয় ছাড়াও নানামুখি সংকটে ভুখছেন এখানকার মানুষ।


সুন্দরবন ঘেঁষা হওয়ায় গাবুরার মানুষদের জীবিকার অন্যতম উৎস বন থেকে মধু, কাঠ, গোলপাতা ও অন্যান্য বনজ দ্রব্য সংগ্রহ করা। সুন্দরবনের পশ্চিম অংশের সিংহভাগ বনজীবীই গাবুরার মানুষ। জলদস্যুদের অত্যাচার এসব মানুষদের জন্য সুদীর্ঘ সময়ের সমস্যা হলেও সাম্প্রতিক সময়ে এ অত্যাচার বেড়ে গেছে বহুগুণে।

সুন্দরবনকে ঘিরে জীবীকার সংস্থান করা বিপুল সংখ্যক মানুষ এখন নিত্য জলদস্যুদের দ্বারা অপহরণ বা প্রাণ হারানোর আতঙ্কে থাকেন। এছাড়া খাদ্য সংকট তীব্র হওয়ায় বাঘ, কুমিরসহ অন্যান্য হিংস্র বন্যপ্রাণীর আক্রমনও বেড়ে গিয়েছে। সর্বোপরি নানামুখি সংকটে উপকূলীয় জনপদ গাবুরায় এখন তীব্র মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।


সম্প্রতি সরেজমিন বিপর্যস্ত গাবুরা ঘুরে দেখার সময় ইউনিয়নের চাঁদনীমুখা বাজারে এই প্রতিবেদকের কাছে তাদের সমস্যার কথা জানাতে উপস্থিত হয় নানা বয়েসের কয়েকশ’ নারী-পুরুষ।

সুন্দরবনের নদীতে মাছ ধরে জীবন পার করে দেওয়া চাঁদনীমুখা গ্রামের বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব আঃ রাশেদ জানান, জলদস্যুদের অত্যাচারে মাছ ধরা এ্যাহন কঠিন হইয়া পড়ছে। জঙ্গলে ৪টি ডাকাত দল রয়েছে। আগে ডাকাতরা সপ্তাহে ২শ’ টাকা কইরা নিত, পরে ৩শ টাকা।


এভাবে ৫শ’ টাকা, ১ হাজার টাকা আর বর্তমানে চায় ১০ হাজার টাকা। টাকা না দিতে পারলে অপহরণ করে নিয়ে যায়। চাহিদা মতো দিতে না পারলে টাকা যতো কম থাকে তত বেতের বাড়ি খাইতে অয়। ডাকাইতগোর টাকার জন্য অনেকে বউয়ের কাপড় পর্যন্ত ঁেবচছে। আমি ছোড বয়েস থাইক্কা মাছ ধরি।

আগে কহনো এমন অয় নাই। বৃদ্ধ জেলে আঃ রশিদ আরও জানালেন, মহাজনদের থেকে দাদনে টাকা নিয়ে মাছ ধরতে যেতে হয় তাদের। অনেক সময় ঋণের টাকাই উঠে আসে না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, বর্তমানে সুন্দরবনে মোতালেব বাহিনী, রাজু বাহিনী, মান্নান বাহিনী ও মাহবুর বাহিনী নামে ৪টি জলদস্যুদের গ্রুপ রয়েছে।


এরমধ্যে মোতালেব বাহিনীর ৩৯ জন সদস্য রয়েছে বলে জানান তিনি। তাছাড়া এসব গ্রুপের প্রচুর সোর্স এলাকায় থাকে। সুন্দবনের নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত বনবিভাগের কর্মীরা সীমিত জনবল ও অস্ত্র দিয়ে সমান্যই ঠেকাতে পারছে জলদস্যুদের এসব তৎপরতা। কিছু বনকর্মীর সঙ্গে জলদস্যুদের সখ্যতার অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগ জানাতে ছুটে আসা ওই এলাকার এক বেকার যুবক জানায়, ঘূর্নিঝড় সিডর-আইলার পর ইউনিয়নের ৯নং সরা (বাঁধ) ইচ্ছে করে ভেঙ্গে দেয় তৎকালীন চেয়ারম্যান ও তার লোকজন। বাঁধের নামে কোটি কোটি টাকা আনলেও খরচ করে নাই।

প্রচুর ত্রাণ আসলেও সেগুলো আমরা পাই নাই। চেয়ারম্যান-মেম্বাররা লুট করে খাইছে। ২০০৯ সালে আইলার পর ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা ঘুরে প্রধানমন্ত্রী প্রতি ঘর মেরামতের জন্য ২০ হাজার টাকা দেয়ার ঘোষণা দেন। এসব বিতরণে জনপ্রতিনিধিদের অর্থের বিনিময়ে  ও স্বজনপ্রীতির কারণে  ক্ষতিগ্রস্থদের অনেকেই পাননি।   এ কারনে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয় ঘোষিত সাহায্যের টাকা।    


গাবুরার চাঁদনীমোখা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোঃ খায়রুল ইসলাম নিলয় জানালেন, বিধ্বস্ত এই জনপদের জন্য জরুরী কিছু করণীয় সম্পর্কে। তাঁর মতে, এই মূহুর্তে গাবুরার মানবিক বিপর্যয় ঠেকাতে ভিত্তিতে এই অঞ্চলে বিপুল সংখ্যক বেকার মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরী করতে হবে।

লবনাক্ত পানি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে এই জনপদকে বাঁচাতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধগুলোর দ্রুত সংস্কার করা জরুরী। বাঁধগুলোকে কমপক্ষে ২০ ফুট উচ্চতা ও ২৫ ফুট চওড়া মাপের করতে হবে। নতুন করে ব্যাপক বনায়ন করতে হবে। লবনাক্ততা বাড়ার ফলে তীব্র খাবার পানির সংকট দেখা দিয়েছে গাবুরায়। পান করার মতো পানির ব্যবস্থাও জরুরী।


গাবুরার মানুষ এক সময় শিক্ষা গ্রহণে পিছিয়ে না থাকলেও এখন শুধু জীবিকার তাগিদে পড়াশুনার শেষ না করেই ছেড়ে দিতে হচ্ছে। তাই এসব শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারের বিশেষ সহায়তা চালু করতে হবে। লবনাক্ত পরিবেশে বসবাসের কারণে এখানকার মানুষদের জ্বর, সর্দিকাশি, ডায়রিয়া, আমাশয়সহ অন্যান্য রোগব্যাধি লেগেই আছে।


স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম এখানে খুবই অপ্রতুল। বিশেষ স্বাস্থ্য সুবিধা বাড়াতে হবে এই এলাকায়। কৃষি কাজে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় গাবুরার প্রায় সব আবাদি জমিই এখন পতিত পড়ে আছে লবনাক্ততার জন্য। লবন সহিষ্ণু জাত উদ্ভাবনের কথা শোনা গেলেও এখানে নতুন প্রযুক্তির এসব জাত এখনও সম্প্রসারিত হয়নি। তাই এই এলাকায় বিরূপ পরিবেশ উপযোগী কৃষি আবাদের সুযোগ সৃষ্টির দাবিও জানান খায়রুল ইসলাম।    

বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।