ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

যে কারণে ইলিশের প্রাচুর্য নেই পদ্মা-মেঘনায়

মুহাম্মদ মাসুদ আলম, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭২৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩, ২০২১
যে কারণে ইলিশের প্রাচুর্য নেই পদ্মা-মেঘনায়

চাঁদপুর: সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর- ইলিশের ভরা মৌসুম। কিন্তু এ সময়ে চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনা নদীতে ইলিশের প্রাচুর্য নেই বললেই চলে।

ফলে হতাশ জেলার অর্ধলক্ষাধিক জেলে।  

দিন-রাত মাছধরা ট্রলার নিয়ে নদীতে চষে বেড়ালেও জ্বালানি খরচ উঠছে না। কেউ কেউ কিছু ইলিশ পাচ্ছেন। মাঝি ও জেলেসহ এক নৌকায়/ট্রলারে ১০-১২ জন কাজ করেন। অল্প সল্প ইলিশ বিক্রি করে কোনোভাবেই পোষানো সম্ভব নয়। ইলিশের প্রাপ্যতা কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে জাটকা ধরা, নদীতে অসংখ্য ডুবোচর, অপরিকল্পিতভাবে নদীতে ড্রেজিং, জাটকা সংরক্ষণ ও মা ইলিশ ডিম দেওয়ার সময়ে শত শত ড্রেজারের মাধ্যমে রেনু বিনষ্ট এবং দক্ষিণাঞ্চলের ফিসিং জোনে একসঙ্গে অনেক জেলের ইলিশ শিকারের কথা জানালেন জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ীরা। তবে ইলিশ পাওয়ার এখনও সময় আছে- বললেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা।

গত কয়েকদিন মেঘনার উপকূলীয় জেলে পাড়া ঘুরে জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত পাঁচ-সাত বছর আগেও চাঁদপুরে এ সময়ে প্রচুর ইলিশ পাওয়া গেছে। কিন্তু এখন সে অবস্থা নেই। দক্ষিণাঞ্চল থেকে আমদানি করা ইলিশের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে ইলিশ ব্যবসায়ীদের।

চাঁদপুর সদরের লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের জেলে দুলাল রাঢ়ী বাংলানিউজকে বলেন, দেখেন, ইলিশের মৌসুম চলে যাচ্ছে, আমাদের খুব কষ্ট হচ্ছে, ইলিশ পাচ্ছি না। দোকানে ঋণ, সংসার চলে না। কিস্তি দিতে পারি না। এখন আর এক মাস বাকি আছে মৌসুম শেষ হতে। ইলিশ পেতেও পারি, নাও পেতে পারি।  

তার মতে, ইলিশ না পাওয়ার কারণ হচ্ছে-নদীতে অনেক ডুবোচর, নদীর দুই পাশে গভীর হলেও মাঝখানে চর। আবার সদর উপজেলার উত্তর পাশে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এসব কারণে নদীর গতি-প্রকৃতি পরিবর্তন হচ্ছে। উত্তরে বালু উত্তোলন করার কারণে এক সময় শহরেরও বড় ধরনের ক্ষতি হবে।

একই ইউনিয়নের রামদাসদী এলাকার জেলে আকবর খান বাংলানিউজকে বলেন, জাটকা ও মা ইলিশ রক্ষায় সরকার নিষেধাজ্ঞা দেয়, অভিযান চালায়। কিন্তু এক শ্রেণির জেলে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে মা ইলিশ ও জাটকা শিকার করেন। আবার অনেকে সরকারি লোকজন ও নেতাদের মাধ্যমে সুযোগ নিয়ে নিষেধাজ্ঞার সময় মাছ ধরেন। এছাড়া যখন মা ইলিশ ডিম দেয়, ডিম তো আর পানিতে ভাসে না, মাটির সঙ্গে লেগে থাকে। ওই সময়ে ড্রেজারের শত শত পাইপে বালুর সঙ্গে ইলিশের ডিমও ওপরে চলে আসে। ড্রেজারে বালু উত্তোলন করার কারণে দুই পাড়েই ভাঙন ঝুঁকি রয়েছে।  

একই এলাকার জেলে মনির গাজী বাংলানিউজকে বলেন, আমরা ইলিশ না পাওয়ার কারণ হচ্ছে শুকনো মৌসুমে এক শ্রেণির জেলে ইলিশের বাচ্চা (জাটকা) মারে। ইলিশ না পেয়ে আমাদের এখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। খেয়ে না খেয়ে কষ্ট করতে হচ্ছে। ঋণগ্রস্ত হচ্ছি। যখনই নদীতে ইলিশ পাওয়া যায়, তখন আবার আসে নিষেধাজ্ঞা।

জেলে ইসমাইল খান ও আবদুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, জাটকা সংরক্ষণ মৌসুমে প্রশাসনের কিছু অসাধু লোক জেলেদের আটক করার পর টাকা দিলে ছেড়ে দেন। তারা পরে আবার জাটকা ধরেন। জাটকা ধরা বন্ধ করতে পারলেই ইলিশ পাওয়া যাবে। নিষেধাজ্ঞা সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি।

সদর উপজেলার হানাচর ইউনিয়নের হরিণা ফেরিঘাট সংলগ্ন মাছঘাটের প্রবীণ ইলিশ ব্যবসায়ী সিরাজুর ইসলাম সৈয়াল বাংলানিউজকে বলেন, চাঁদপুরে এ বছর ইলিশের খুবই আকাল। বেকার বসে থাকতে হচ্ছে আড়তদারদের। খুব কম সংখ্যক ইলিশ পাওয়া যায়, যাতে কিছুই হয় না। নদীতে অনেক চর পড়েছে। সাগর থেকে নদীর যে স্থান দিয়ে ইলিশ উজানে আসে, সেখানে দুই পাশে চর। মাঝখানে যে জায়গাটুকু খালি, সেখানে অনেক জাল দিয়ে বাধাগ্রস্ত করা হয়। যার ফলে পদ্মা-মেঘনায় ইলিশ খুবই কম।

চাঁদপুর জেলা মৎস্য সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি আব্দুল বারি জমাদার মানিক বাংলানিউজকে বলেন, বিগত কয়েক বছর আমাদের চাঁদপুরে পদ্মা-মেঘনা নদীতে ইলিশের উৎপাদন অনেক কমে গেছে। এর কারণ বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, নদীতে চর জেগেছে, নদীর নাব্য কমে যাচ্ছে এবং সাগর থেকে যখন মেঘনায় মাছ উঠবে, সেখানে বরিশাল, হাতিয়া ও ভোলায় অসংখ্য জেলে একসঙ্গে ইলিশ আহরণ করেন। এতো জেলে ও জাল পেরিয়ে মেঘনায় ইলিশ আসা খুবই দুরূহ ব্যাপার।

তিনি বলেন, ইলিশ কমে যাওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন। সরকার জাটকা রক্ষায় মার্চ-এপ্রিল দুই মাস এবং মা ইলিশ রক্ষায় ২২ দিন সময় নির্ধারণ করেছে, ওই সময়ও অপরিকল্পতিভাবে বালু উত্তোলন করা হয়। ডিম ছাড়ার সময় যে বালু উত্তোলন হয়, তখন ইলিশের ডিমগুলো মারা পড়ে। এ বিষয়টি মৎস্য বিজ্ঞানীরাও বলেছেন। কারণ মৎস্য বিজ্ঞানী ও জেলেরা নদীতে অবস্থান করেন। তারাই আমাদের সঙ্গে বাস্তব অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন।

ইলিশ তো নোনা পানিতে ডিম ছাড়ে না। মিঠা পানিতে ডিম ছাড়ে। মিঠা পানিতে যত বেশি ডিম ছাড়বে, ততবেশি ইলিশের উৎপাদন বাড়বে। এখন আমরা দেখছি নোনা পানি অর্থাৎ সাগরে ইলিশের উৎপাদন বেড়ে যাচ্ছে এবং মিঠা পানিতে কমে যাচ্ছে। এটি ইলিশ উৎপাদনের জন্য সতর্ক বার্তা। এ ক্ষেত্রে ডুবোচর কাটা, নদীর পানি দূষণ কমানো ও অপরিকল্পিত ড্রেজিং বন্ধ করে মিঠা পানিতে ইলিশের বিচরণ নিশ্চিত করতে হবে, যোগ করেন তিনি।

চাঁদপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা গোলাম মেহেদী হাসান বাংলানিউজকে বলেন, চাঁদপুরে ইলিশের প্রাপ্যতা বাড়ে সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত। যেহেতু সেপ্টেম্বর শুরু হয়েছে, আশা করছি, অচিরেই প্রচুর ইলিশ ধরা পড়বে। কিন্তু গত বছরের তুলনায় এ বছর ঠিক এ সময়টাতে বৃষ্টিপাত কম হওয়ার কারণে আমরা ইলিশ কিছুটা কম পাচ্ছি। তবে আশা করছি, জেলেরা ইলিশ পাবেন এবং বাজার ইলিশে সয়লাব হবে।

বাংলাদেশ সময়: ০৭২২  ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৩, ২০২১
এনএসআর/এসআই
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।