ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

নাটোরে বারনই নদীতে পাট জাগ, মারা যাচ্ছে অভয়াশ্রমের মা মাছ

মো. মামুনুর রশীদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪৭ ঘণ্টা, জুলাই ২৭, ২০২২
নাটোরে বারনই নদীতে পাট জাগ, মারা যাচ্ছে অভয়াশ্রমের মা মাছ

নাটোর: পানিতে অ্যামোনিয়া গ্যাস বৃদ্ধি ও অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাওয়ায় নাটোরের বারনই নদীতে থাকা ছয়টি অভয়াশ্রমের মা মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির ছোট-বড় মাছ মারা যাচ্ছে।  

নদীর পানিতে পাট জাগ দেওয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

এতে এবার নদীতে মাছের উৎপাদন কমবে এবং ফিরে আসা বিলুপ্ত প্রায় মাছগুলো আবার হারিয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।  

স্থানীয়রা বলছেন, গত তিনদিনের ব্যবধানে বারনই নদীর কয়েকশ’ টন মাছ মারা গেছে। যার একেটির ওজন প্রায় পাঁচ কেজি থেকে ২৫-৩০ কেজি বলে জানা গেছে।

নলডাঙ্গা উপজেলার কাশিয়াবাড়ি থেকে কালিগঞ্জ পর্যন্ত নদীর দু’ধার ঘুরে দেখা গেছে, নদীর দুই তীরে সারি সারি করে পাট জাগ দেওয়া হয়েছে। কেউ পাট নতুন করে জাগ দিচ্ছেন, কেউ বা আঁশ ছাড়াচ্ছেন, কোথাও কোথাও পাট পচে কালো রং ধারণ করেছে। এমনকি পানির রংও বিবর্ণ হয়ে গেছে। নদীতে থাকা মাছের অভয়াশ্রম ও তার আশ-পাশে পাট জাগ দেওয়া হয়েছে।

এতে অভয়াশ্রমসহ নদীর ছোট-বড় সব রকম মাছ মরে ভেসে উঠছে। স্থানীয় লোকজন এসব মাছ তুলে নিচ্ছেন। পাট জাগ দেওয়ার কারণেই মাছ মারা যাচ্ছে এমন অভিযোগ তোলেন স্থানীয়রা। তবে বিকল্প কোনো ব্যবস্থা না থাকায় বাধ্য হয়েই কৃষকরা নদীতে পাট জাগ দিচ্ছেন বলে জানা গেছে। কারণ অনাবৃষ্টি, প্রচণ্ড খরার কারণে খাল-বিল-জলাশয়গুলোতে পানির দেখা মিলছে না। সংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ হতাশা ব্যক্ত করে বলছেন, কৃষিকে বাঁচাতে গিয়ে মাছ মারা যাচ্ছে।

শ্যামনগর গ্রামে অভয়াশ্রমের পাশের বাসিন্দা আবু সাঈদ জানান, গত দুই-তিনদিন ধরে বারনই নদীতে বিশেষ করে অভয়াশ্রমে বড় বড় বোয়াল, আইড়, ব্ল্যাক কার্পসহ বিভিন্ন ধরনের মা মাছ মরে ভেসে উঠছে। এসব মাছের ওজন ১০ কেজি, ২০ কেজির কম নয়। নিজ চোখেই এসব মরা মাছ ভেসে যেতে দেখেছেন। নদীর দুই পাড়ের মানুষকে এসব মাছ তুলে নিতে দেখেছেন।

বাঁশভাগ গ্রামের বাসিন্দা ও পিপরুল ইউপি সদস্য সাকিবুল হাসান জানান, খাল, বিল, নদীতে পানি নেই। তাই কৃষকরা পাট জাগ দেওয়ার জন্য নদীতে এনেছেন। আগে কখনও কৃষকরা নদীতে পাট জাগ দিতেন না। এবার পাট জাগ দেওয়ায় কৃষকদের সুবিধা হলেও দেশের জাতীয় সম্পদ মাছের ক্ষতি হচ্ছে।  

তিনি অভিযোগ করে বলেন, বারনই নদীর পুঠিয়া এলাকায় রাবার ড্যাম বন্ধ করে দেওয়ায় নদীর পানি শুকিয়ে গেছে। বিষয়টি অনেক আগে কর্তৃপক্ষকে জানানো হলেও কেউ কোনো পদক্ষেপ নেননি। যদি আগে থেকেই ব্যবস্থা নেওয়া যেত এবং রাবার ড্যাম খুলে দিয়ে পানি প্রবাহ ঠিক রাখা হতো, তাহলে মাছের এতো বড় ক্ষতি হতো না।

একই কথা বলেন পাটুল গ্রামের আকতার হোসেন, আচড়খালি গ্রামের আবুল হোসেন ও পিপরুল নাথুরঘাট এলাকার আনসার আলীসহ অনেকে। তারা বলেন, শুধু শ্যামনগর নয়, পিপরুল নাথুরঘাট, কালিগঞ্জসহ সব অভয়াশ্রম এবং পুরো নদীতেই মাছ মারা যাচ্ছে। নদীর সব খানেই পাট জাগ দেওয়া হয়েছে। পাট জাগ দিতে না দিলে কৃষকের সমস্যা আর পাট জাগ দিলে মাছের সমস্যা।  

তারা বলছেন, এক দিকে মৎস্য সম্পদ বিনষ্ট হচ্ছে, অন্য দিকে নদীতে পাট জাগ দিতে পারলেও দূর থেকে পরিবহন খরচ দিয়ে পাট আনতে হচ্ছে নদীতে। এতে খরচ বেশি হচ্ছে, সঠিক সময়ে, সঠিকভাবে জাগ দিতে না পারায় আঁশও কম হচ্ছে।  

তাদের দাবি, দ্রুত রাবার ড্যাম খুলে দিয়ে পানি প্রবাহ বাড়াতে হবে। পাট জাগের বিকল্প বের করতে হবে। তা না হলে মাছ ও কৃষি উভয় সম্পদই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

উপজেলা মৎস্য বিভাগ জানায়, বারনই নদীতে ছয়টি অভয়াশ্রম রয়েছে। বিগত কয়েক বছর ধরে সেখানে মা মাছ রক্ষা করা হচ্ছে। এতে করে নদীতে মাছের উৎপাদন বেড়েছে কয়েকগুণ। পাশাপাশি বিলুপ্ত প্রায় বিভিন্ন প্রজাতির মাছও ফিরে এসেছে। কিন্তু এবার নদীতে পাট জাগ দেওয়ার কারণে মাছ মারা যাচ্ছে।  

সূত্রটি আরও জানায়, পানিতে পাটের পচন কষ থেকে প্রচুর পরিমাণ অ্যামোনিয়া গ্যাস সৃষ্টি হয় এবং অক্সিজেনের মাত্রাও কমে যায়। যা মাছের জন্য বেশ ক্ষতিকর দিক। পানি প্রবাহ না বাড়লে আরও বড় ধরনের ক্ষতি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

নলডাঙ্গা উপজেলা পরিষদ ভাইস চেয়ারম্যান মো. আব্দুল আলিম সরদার অভিযোগ করে বাংলানিউজকে বলেন, গত কিছুদিন আগেও নদীতে স্রোত ছিল, পানি ছিল। বর্তমানে রাবার ড্যাম বন্ধ করার কারণে বারনই নদীতে পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে নদীর পানি কমে যাওয়ায় এবং পাট জাগ দেওয়ার কারণে নদীর মাছ মারা যাচ্ছে। আর খাল-বিল ও ডোবায় পানি না থাকায় কৃষকরা বাধ্য হয়ে বারনই নদীতে পাট জাগ দিচ্ছেন।  

তিনি বলেন, পাট জাগ দিতে না পারলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন আবার পাট জাগ দিলে মাছেরও ক্ষতি হবে। এক্ষেত্রে নদীতে পানি প্রবাহ স্বাভাবিক থাকলে এবং পানির স্রোত থাকলে কিছুটা হলেও মাছ রক্ষা করা সম্ভব হবে। এজন্য দ্রুত রাবার ড্যাম খুলে দেওয়া প্রয়োজন।

নলডাঙ্গা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ ফৌজিয়া ফেরদৌস বাংলানিউজবে বলেন, মাছ ও পাট দু’টিই আমাদের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। এ দু’টিই রক্ষা করতে হবে। এবার গত বছরের তুলনায় ১০০ হেক্টর বেশি জমিতে পাটের আবাদ হয়েছে। কিন্তু প্রয়োজন অনুযায়ী বৃষ্টি না হওয়ায় খাল-জলাশয়গুলো পানিশূন্য, নদ-নদীতে পানি কম। অনাবৃষ্টি আর অতিরিক্ত খরায় জলাধারগুলোতে এবার পানি নেই। ফলে কৃষকরা সঠিক সময়ে, সঠিকভাবে পাট জাগ দিতে পারছেন না। আগে ক্ষেতের পাশেই নিচু জমিতে জমে থাকা পানিতে পাট জাগ দিতে পারতেন তারা। সেটা করতে না পারায় তারা পরিবহন খরচ দিয়ে হলেও দূর থেকে পাট এনে বারনই নদীর পানিতে জাগ দিচ্ছেন। পাট পচনশীল হওয়ায় পানির রং কিছুটা হলেও বিবর্ণ হয়ে যায়। এতে মাছের কিছুটা হলেও ক্ষতি হয়। তবে নদীতে পানির প্রবাহ স্বাভাবিক থাকলে এমনটি হতো না।

নলডাঙ্গা উপজেলা মৎস্য অফিসার সঞ্জয় কুমার সরকার বাংলানিউজকে জানান, অনাবৃষ্টি আর খরার কারণে পাট জাগ দেওয়ার পর্যাপ্ত পানি পাচ্ছেন না কৃষকরা। তাই তারা বাধ্য হয়ে বারনই নদী ও হালতিবিলে পাট জাগ দিচ্ছেন। এতে অক্সিজেন ঘাটতি ও গ্যাসের প্রভাবে মারা যাচ্ছে মাছ।  

নলডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুখময় সরকার বাংলানিউজকে জানান, বিষয়টি জানার পর পরিস্থিতি মোকাবিলায় রাবার ড্যাম খুলে দিয়ে পানি প্রবাহ স্বাভাবিক করার জন্য বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন প্রকল্পের সহকারী প্রকৌশলীকে বলা হয়েছে। তারা দ্রুত ব্যবস্থা নেবেন বলে আশা করা হচ্ছে।  

তিনি বলেন, কৃষি ও মৎস্য দু’টিই আমাদের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। কাজেই দু’টি সম্পদের কথা বিবেচনা করে আমাদের ব্যবস্থা নিতে হবে। সেই লক্ষ্যে উপজেলা প্রশাসন তৎপর রয়েছে।

রাজশাহী বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন প্রকল্পের পুঠিয়া-বাঘা ও চারঘাট এলাকার দায়িত্বরত সহকারী প্রকৌশলী মো. মামুনুর রশীদ বাংলানিউজকে জানান, প্রচণ্ড খরায় খাল-বিল ও নদীতে পানি নেই। এজন্য রাবার ড্যাম এলাকার সুবিধা ভোগীদের সঙ্গে এবং পরিচালনা কমিটির সঙ্গে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে কয়েকদিনের জন্য পাট জাগানো হয়েছে। তবে উভয় পাশে লেভেল বিবেচনা করেই এটা করা হয়েছে। যাতে উভয় এলাকার মানুষ সুবিধা পান। আগে থেকেই নদীতে পানি প্রবাহ ও স্রোত কম ছিল। তবে নদীতে মাছ মারা যাওয়ার বিষয়টি জানার পর বুধবার (২৭ জুলাই) ড্যাম আংশিক ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আশা করছি, দুই-একদিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৬২৫ ঘণ্টা, জুলাই ২৬, ২০২২
এসআই
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।