ঢাকা, মঙ্গলবার, ২০ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

শিলপাটা খুঁটিয়েই চলে যাদের জীবন

মুশফিক সৌরভ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৭ ঘণ্টা, মার্চ ২, ২০২৩
শিলপাটা খুঁটিয়েই চলে যাদের জীবন শিলপাটায় নকশা করছেন দুই কারিগর। ছবি: বাংলানিউজ

বরিশাল: খাবারের স্বাদ বাড়াতে আগে বাসাবাড়ির পাশাপাশি হোটলেগুলোতে শিলপাটায় বিভিন্ন বাটা মসলার ব্যবহার করা হতো। ৯০ দশকে মসলা গুড়া করার মিলের আবির্ভাব এবং বিংশ শতাব্দিতে এসে ঘরে ঘরে ব্লেন্ডারের বিস্তার শিলপাটার ব্যবহার অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে।

এর ধারবাহিকতায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিলপাটার চাহিদা কমে যাওয়ায় এ ব্যবসা থেকে যেমন অনেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন। তেমনি আবার এই শিলপাটা খুঁটানো (ধার দেওয়ার বা নকশা) পেশায় থাকা ব্যক্তিরাও হারিয়ে যেতে বসেছেন। টিকে থাকা কারিগররা শিলপাটা খুঁটানোর কাজ ছাড়া অন্য কোনো কাজ না পারায় তারাও এখনও জীবিকার তাগিদে অনেকটাই স্রোতের বিপরীতে গিয়ে পেশাটি ধরে রাখার চেষ্টা করছেন।

বরিশাল নগরে ঐতিহ্যবাহী হাটখোলা এলাকায় হারিয়ে যেতে যেতেও টিকে থাকা যে দুটি প্রতিষ্ঠান এখনও পাথরের শিলপাটা বিক্রি করছেন। সেখানেই পাটা খুঁটানোর কাজ করেন পঞ্চাশোর্ধ আবুল হোসেন।

বোন জামাইয়ের কাছ থেকে কাজ শেখার পর ৩০ বছর ধরে যিনি এ পেশায় যুক্ত থেকে জীবিকা নির্বাহ করছেন। তবে শিলপাটা খুঁটাই বা ধার দেওয়ার কাজটি এখন মেশিনেও করা সম্ভব হয় বলে শ্রমের এ বাজার থেকে ছিটকে পড়ার শঙ্কায় রয়েছেন আবুল হোসেন।  
 



তিনি বলেন, পাটা খুঁটানোর কাজ করে যেটুকু জীবিকা নির্বাহ হয় তা দিয়ে চারজনের সংসার কোনোভাবে চলে যাচ্ছে। যন্ত্রের আবির্ভাব এখানেও হয়েছে।  হাতে শিলপাটা খুঁটাতে যেসময় লাগে তা হয়তো যন্ত্রের প্রয়োজন হবে না, তবে মেশিনে খুঁটানো পাটার থেকে হাতে খুঁটানো পাটার কারিশমা একটু আলাদাই থাকবে।

যশোর থেকে বরিশালে এসে ১৫ বছর ধরে এ পেশায় যুক্ত থাকা মো. জামাল নামের অপর কারিগর বাংলানিউজকে বলেন, খুঁটানো বা ধার দেওয়া শিলপাটার ব্যবহারে মসলা দ্রুত মিহি হয়। এর ফলে মসলার স্বাদসহ গুণগতমানও সঠিক থাকে। তাই খুঁটানো বা ধার দেওয়া শিলপাটার ব্যবহার গোটা দেশেই হয়ে থাকে। তবে বরিশালের চকবাজার ও হাটখোলা এলাকার কারিগরদের পাটা খুঁটানো বা ধার দেওয়ার কদর ছিল গোটা দক্ষিণাঞ্চলজুড়েই। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিলপাটা ও পুতা বিক্রেতার সংখ্যা যেমন কমেছে, তেমনি আমাদের মতো কারিগরদের সংখ্যাও দিন দিন কমছে। এখন তো টিকে থাকা দুটি প্রতিষ্ঠানে আমরা হাতে গোনা  ৭ থেকে ৮ জন কাজ করছি।  তাও আবার মেশিনের যুগ চলে আসায় কমে গেছে পারিশ্রমিক, তারপরও যা উপার্জন করছি তা দিয়ে চারজনের সংসার কোনোভাবে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।  

শিলপাটার বিক্রেতাদের সঙ্গে ধার করানো কারিগরদের জৌলুশ যে ২০ বছর আগের অবস্থানে নেই তা জানিয়ে স্থানীয় বাসিন্দা মিথুন সাহা বলেন, ছোটবেলায় বরিশাল নগরের চকবাজারের পুল থেকে মধ্য হাটখোলা পর্যন্ত হার্ডওয়ারের দোকানসহ সড়কের দুইধারেই যেমন শিলপাটা-পুতা বিক্রি হতে দেখেছি, তেমনি সেগুলো ধার করানোর লোকের অভাব ছিল না। তখন ট্রাকে চেপে একসঙ্গে পাথরের শিলপাটা আসতো। এর একটি দিয়ে একইসঙ্গে মসলা বাটার একটি শিলপাটা ও একটি পুতা তৈরি করা হতো। আর সেই পাটা-পুতা যেমন মজবুত ছিল তেমনি বিভিন্ন সাইজেরও ছিল। কিন্তু এখন এসব দৃশ্য দেখতে পাওয়াটাই দুষ্কর, তার ওপর শিলপাটাতো পাওয়াই যায় না। আগে বাসাবাড়িতে ছোট ও মাঝারি ধরনের পাটা ব্যবহার করা হতো আর খাবার হোটেলগুলো বড় আকারের পাটা ব্যবহার হতো। পাটায় বাটা মসলা দিয়ে রান্না করা খাবারের স্বাদও ছিল অন্যরকম। যেটাও এখন উপভোগ করা যায় না।  
 



তিনি বলেন, ৯০ দশকে মরিচ ও হলুদ গুড়ার মেশিন নিয়ে বাজার ও পাড়া-মহল্লায় ছোট ছোট মিল বা দোকানগুলো গড়ে উঠতে শুরু করলেই জৌলুশ হারাতে শুরু করে শিলপাটা-পুতা। মসলা বাটার কষ্ট কমাতে শুরু হয় বাজার থেকেই মরিচ ও হলুদের গুড়া করে নিয়ে যাওয়ার প্রথা। এর এক দশক পর ব্লেন্ডারের প্রথাটা এতটাই জনপ্রিয় হয় যে, বাসাবাড়ির সঙ্গে সঙ্গে হোটেলগুলোতেও শিলপাটা-পুতার ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায়। আর এর মাঝেই বিক্রেতাদের শিলপাটা খুঁটানো কারিগররা হারিয়ে যাচ্ছে। এখন আর মেনাজ বাশার, সোহাগসহ জনপ্রিয় শিলপাটা খুটানোর কারিগরদের নামগুলো ধরে মানুষের ডাকাডাকি যেমন শোনা যায় না, তেমনি লোহার সেনি-হাতুড়ি দিয়ে শিলপাটা খুঁটানোর শব্দও পাওয়া যায় না।
 
জানা গেছে, বরিশাল নগরের ঐতিহ্যবাহী হাটখোলা ও চকবাজার পুল এলাকায় ৮০ এর দশকে ২৫ জনের মতো ব্যবসায়ী ছিলেন যারা শিলপাটা-পুতা বিক্রি করতেন। তবে এখন তা মাত্র দুইজনে করেন।  আবার তখন বছরজুড়ে বেচাবিক্রি ভালো হওয়ায় প্রচুর কাজের চাপ থাকতো শিলপাটা-পুতা খুঁটানোর কারিগরদের। এখন বছরে নির্দিষ্ট সময় বিশেষ করে রমজানের আগে কাজের চাপ থাকে এবং সর্বোপরি কমেছে কারিগরদের সংখ্যা।

এদিকে খুঁটানো কাজে মেশিনের ব্যবহার শুরু হওয়ায় কর্মসংস্থান হারানোর শঙ্কায় রয়েছেন নামমাত্র হাতে গোনা কয়েকজন কারিগররা।  এরই মধ্যে পুতা খুঁটাইয়ের কাজ হাটখোলায় কেউই করছেন না, এটি মেশিনের সাহায্যে গৌরনদী থেকে তৈরি হয়ে আসছে।

শিলপাটা ধারের কারিগর জামাল বলেন, মেশিন আসার আগে এক শিলপাটা খুঁটে ৪০ টাকা পেতাম।  এখন পাই ৩৫ টাকা। কাজের চাপ থাকলে হয়তো দিনে ১৫-২০টি পাটা খুঁটতে পারি। কিন্তু চাপ না থাকলে যত শিলপাটার সংখ্যা কমবে ততই আয় কমবে। তাই পেশায় ঝুঁকি দেখে অনেকেই বহু আগে ভিন্ন পেশায় চলে গেছেন আর আমরা যারা আছি তারা এ কাজ ছাড়া কোনো কাজই পারি না। যদি এ কাজ  বন্ধ হয়ে যায় তবে খুব দুর্দিন যাবে আমাদের।  

বাংলাদেশ সময়: ১৫১৫ ঘণ্টা, মার্চ ০২, ২০২৩
এমএস/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।