ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

মুক্ত মঞ্চে উন্মুক্ত দর্শকের চোখে মুখে যাত্রা উৎসব

মো. রাজীন উদ্দিন চৌধুরী, সিনিয়র ফটো করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০১৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ৭, ২০২৪
মুক্ত মঞ্চে উন্মুক্ত দর্শকের চোখে মুখে যাত্রা উৎসব

ঢাকা: যাত্রা হারিয়ে গিয়েছে কালের বিবর্তনে অথবা আধুনিকায়ন চলনের ধারায়, কিছু নষ্ট হয়েছে অশ্লীলতার গ্যাঁড়াকলে।

‘ঢাকার ফাঁকা জায়গায় জনগণের সঙ্গে মিশে গিয়ে উন্মুক্ত মানুষের ঢলে মঞ্চায়িত যাত্রাপালা পরিবেশনের মাধ্যমে সাধারণ জনগণের সঙ্গে সংস্কৃতির বিকাশ ছড়িয়ে দেবেন এই নতুন বাংলাদেশে’, এমনভাবেই হয়তো ভেবেছেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক ড. সৈয়দ জামিল আহমেদ! সাধারণ জনগণ লুফেও নিয়েছেন উনার আইডিয়া, জাত পাত ভুলে এক সঙ্গে দেখছেন যাত্রাপালা।

ছোট-বড়, ধনী গরিব এক সঙ্গে দেখছে, হাসছে, তালি দিচ্ছে, কেউ গালে হাত দিয়ে গভীর মনোযোগে চেয়ে আছে, কেউ আবার সিটি বাজিয়ে আয়োজনের কেন্দ্রে। জেনারেশন অনুযায়ী যদি দেখতে যাই আমরা, বাংলানিউজের  ছবি বলে দেবে কয়েকটি জেনারেশনের একত্রিত সম্মেলন ঘটেছে এই যাত্রা উৎসবে।  

পুরো মুক্ত মঞ্চ আলোকিত গ্যালারি ভর্তি জনগণ, মঞ্চ বরাবর বসার জায়গা না পেয়ে দাঁড়িয়ে বা দেয়ালে উঠে বসেছে উৎসুক জনতা উৎসবমুখর হয়ে।

৩৯ বছর বয়সী মোহাম্মদ আশরাফী ইস্কাটন থেকে অফিস শেষ করে চলে এসেছেন যাত্রা দেখতে। অফিস শেষ করে বাসায় না গিয়ে যাত্রা দেখতে আসার কারণ জানতে চাইলে তিনি বাংলানিউজকে জানান, ‘মেট্রোরেলে করে মিরপুর যাবো, অফিস শেষ টাইমে অনেক ভিড় থাকে। ধাক্কা ধাক্কি করে ট্রেনের ভেতরে ঢুকতে হয়, যা সারাদিনের অফিস শেষে শরীর মানতে চায় না, তাই সন্ধ্যায় হাঁটতে হাঁটতে চলে আসি মুক্ত মঞ্চে, চা আড্ডায় কেটে যায় সময় তারপর ফাঁকা হয়ে আসে মেট্রো, তখন বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেই এবং ১০ টার আগেই বাসায় পৌঁছাই। এই ছয়দিন অবশ্য যাত্রাপালা উৎসব থাকায় সময় কেটেছে বিনোদনের মধ্যদিয়ে। আমি পালা দেখে শেষে মেট্রোরেল ধরে আরামে চলে যাই বাসায়। ফ্রি তে সংস্কৃতি চর্চার ব্যবহার ধাক্কা খাওয়ার থেকে উত্তম মনে হয় আমার কাছে।

এদিকে গোলাম ও চিত্রা, হাসিব ও মনিকা জিগাতলায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন এক সঙ্গে, ‘লালন ফকির’ পালা হওয়ার দিন তাদের সঙ্গে কথা হয় বাংলানিউজের। আগে কখনো এভাবে যাত্রা দেখতে আসার গল্প জানতে চাইলে তারা বলেন, গ্রাম থেকে ঢাকা এসেছি পড়াশুনা করার জন্য, হোস্টেলে থেকে আমাদের জীবনযাপন চলে একই ধারাবাহিকতায়। গ্রামে যখন ছিলাম তখন যাত্রাপালার গল্প শুনেছি নগ্নতার, তাই দেখার ইচ্ছা জাগে নাই। ফেসবুকের মাধ্যমে জানতে পারি এখানে সাত দিনব্যাপী যাত্রাপালার আয়োজন চলছে তাও আবার উন্মুক্ত, তাই বন্ধুরা মিলে প্ল্যান করে আসলাম লালন ফকির যাত্রাপালা দেখতে। পরিবেশ ও আয়োজন ভালো লেগেছে, ধন্যবাদ শিল্পকলা একাডেমিকে এমন সুন্দর একটি কালচারকে পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নেওয়ার জন্য। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি শেষ দিনে সিরাজউদ্দৌলা দেখতে আসবো আরও অনেক বন্ধুদের নিয়ে।

ইতিহাস বলে মূলত যাত্রাপালার বিকাশ শুরু হয় ১৮০০ শতকের মাঝামাঝি সময়ে থিয়েটার ও নাটকের আগে। যার কারণে যাত্রার ঐতিহ্যকে প্রথমেই তুলে ধরতে হয়। নাট্যাচার্য শিশির কুমার ভাদুড়ি বলে গিয়েছেন, ‘আমাদের জাতীয় নাট্য বলিয়া যদি কিছু থাকে তাহাই যাত্রা’।

বাংলার যাত্রা শিল্পের ইতিবৃত্ত জানতে হলে বৈষ্ণবধর্ম ইতিহাস জানতে হবে, যা ১৪৮৬-১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দের গল্প। বৈষ্ণব সন্ন্যাসী শ্রী চৈতন্যদেব অনুভব করেছিলেন, বক্তৃতা করে বাংলার মানুষকে যা বোঝানো যাবে না, যাত্রাভিনয়ের মাধ্যমে তা মানুষের মনে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। কারিকুলাম শিক্ষা না থাকা জনগণ যাত্রাগান শুনে অনেক কিছু জানতে বা বুঝতে পারতো। দেশপ্রেম, বাস্তবতা ও অসাম্প্রদায়িক ভাবনা সৃষ্টির উৎস ছিল এই যাত্রা।

নদীমাতৃক এই দেশে একসময় বর্ষাকাল থেকে শীতকাল পর্যন্ত খাল-বিল, নদী-নালা পানিতে ভরা থাকতো। সেসময় নৌকা ছিল যাত্রাদলের অনুশীলন কেন্দ্র, বছরের সাত আট মাস নৌকায় থাকতো যাত্রাশিল্পীদের ঘরবাড়ি। এক গঞ্জ থেকে আরেক গঞ্জের পথে নদীবক্ষে যাতায়াত, বড় নৌকায় সময় কেটে যেতো নাচ ও গানে আর রিহার্সেলের মধ্য দিয়ে।

ক্রমবিবর্তনের ধারায় শতাব্দীর পর শতাব্দী অতিক্রম করে তৎকালীন বাংলার ঢাকাতে প্রথম যাত্রাপালা সীতার বনবাস হয়, এর কাহিনিকার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। নাট্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক জিয়া হায়দার বলেছেন, ‘যাত্রাই হতে পারে আমাদের জাতীয় নাট্য’।

১৯৪৭ সালে ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার যতীন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘জয়দুর্গা অপেরা’তে নৃত্যশিল্পী জ্যোৎস্নারাণী দত্তের মাধ্যমে ছেলেদের মেয়ে সাজিয়ে অভিনয়রীতির ব্যতিক্রম ঘটে। উল্লেখ্য, দেশভাগ হওয়ার পূর্বে পেশাদারি যাত্রাপার্টি ছাড়া শৌখিন যাত্রাদলে নারীরা অভিনয় করতো না। তখন ছেলেরা মেয়ে সেজে অভিনয় করতো।

বিখ্যাত নট্টকোম্পানি যাত্রাপার্টি দুই বাংলায় জনপ্রিয় দল ছিল ব্রিটিশ আমলে। ১৯৩০ সালে মুসলিম পরিচালিত প্রথম যাত্রাদল হলো ‘মুসলিম যাত্রা পার্টি’, যা চালু করেন পটুয়াখালীর মোজাহের আলী সিকদার এবং তিনি ১৯৬৬ সালে ‘বাবুল যাত্রাপার্টি’ নামের আরেকটি যাত্রাদল গঠন করেন যা একসময় বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেন।

 তার কিছু বছর আগে চট্টগ্রামের আমিন শরীফ চৌধুরী ১৯৫৮ সালে ‘বাবুল অপেরা’ নামে একটি যাত্রাদল গঠন করেন, যা অল্পকিছুদিনের মধ্যেই স্বনামধন্য যাত্রাদল হিসেবে পরিচিতি পায় এবং ১৯৬০ সাল থেকে এ দলে নারীশিল্পীরা অভিনয় করতে শুরু করে।

 বাংলাদেশ সময়: ১০১৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৭, ২০২৪
 আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।