ঢাকা, শুক্রবার, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৬ মে ২০২৫, ১৮ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

সুতোয় বোনা জামদানি পল্লির এক ঝলক

দেলোয়ার হোসেন বাদল, সিনিয়র ফটো করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭:৪১, মে ১৬, ২০২৫
সুতোয় বোনা জামদানি পল্লির এক ঝলক

নারীর সৌন্দর্যের প্রতীক, বাংলাদেশের গর্ব। জামদানি শাড়ি শুধু একটি পোশাক নয়, এটি একটি ইতিহাস, একটি শিল্প।

ঢাকার ঠিক পাশেই, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের নোয়াপাড়াসহ আশপাশের গ্রামে গড়ে উঠেছে এক বিস্ময়কর শৈল্পিক জনপদ জামদানি পল্লি।

এখানকার কয়েটি গ্রামে প্রায় পাঁচ হাজার তাঁতি রয়েছে। প্রতিটি বাড়ি যেন একেকটি ছোট তাঁতশালা। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁতের ঠকঠক শব্দে ভরে ওঠে বাতাস।  এখানে সুতোয় সুতোয় শুধু শাড়ি বোনা হয় না বরং বোনা হয় ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংগ্রামের গল্প।

এদেশের ঐতিহ্য জামদানি শাড়ির বিভিন্ন ডিজাইন হয়ে থাকে। তার মধ্যে অন্যতম, পান্না হাজার, তেরছা, পানসি, ময়ূরপঙ্খী, বটতপাতা, করলা, জাল, বুটিদার, জলপাড়, দুবলী, ডুরিয়া, বলিহার, কটিহার, কলকাপাড়সহ জামদানির ইত্যাদি ডিজাইন বেশ জনপ্রিয়।

নকশায় নকশায় নিখুঁত ধৈর্য, সূক্ষ্ম দক্ষতা আর অন্তহীন পরিশ্রমের মেলবন্ধন। এই শিল্পের পেছনে আছেন এমন কিছু মানুষ, যারা দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ধরে হাতে বুনে চলেছেন আমাদের ঐতিহ্য। অথচ তাঁদের জীবন মান খুবই কষ্টের। নুন আনতে পান্তা ফুরায়।

৬৫ বছর বয়সী তাঁতি আবদুল গফুর বলেন, এই কাজটা হিন্দি সিনেমার প্রেমে পড়ার মতো। একবার যেই পড়বেন, ছুটতে পারবেন না। সেই যে বাবার হাত ধরে কিশোর বয়সে কাজ শুরু করে জীবনে শেষ প্রান্তে এসেও কাজ ছাড়তে পারিনি।

তাঁতের ঘরে প্রবেশ করতেই কাঁচা সুতো আর মানুষের ঘামের মিশেলে তৈরি এক চিরন্তন পরিশ্রমের কাঁচা গন্ধ। একপাশে বসে আছেন রাবেয়া বেগম, তার হাতে নিপুণভাবে চলছে সুতোয় সুতো গাঁথার খেলা।  

তিনি বলেন, এই কাজ এখন মেয়েরাও শেখে। আগে শুধু পুরুষরা করতো, জামদানির কাজ করে এখন মেয়েরাও সংসারের হাল ধরতে শিখেছে।

জামদানি নামেই যেন জড়িয়ে আছে রাজকীয়তা। মোঘল আমলে এই শাড়িকে বলা হতো ‘রূপকথার মেঘ’।

হাতে বোনা এই শাড়ি তৈরিতে সময় লাগে গড়ে সাত দিন থেকে শুরু করে ২-৩ মাস পর্যন্ত, নির্ভর করে নকশার জটিলতার ওপর।  একেকটা শাড়ি তৈরির জন্য প্রয়োজন হয় দুই দক্ষ কারিগর, যারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করে।

প্রথমে সুতার প্রস্তুতি, তারপর তাঁত বসানো, এরপরে হাতে হাতে সূক্ষ্ম নকশা তোলা। প্রতিটি ধাপেই আছে পরিশ্রম, ধৈর্য আর দক্ষতা।

শ্রমিকরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করেন। অধিকাংশই পরিবারভিত্তিক কাজ, বাবা-মা, ছেলে-মেয়ে সবাই কেউ নকশা তোলেন, কেউ সুতার জট ছাড়ান। পুরুষরা মূলত তাঁতে কাজ করেন, নারীরা নকশা কাটেন ও রঙ প্রস্তুত করেন।  

শিল্পী হলেও তাদের জীবন অনেক কষ্টের। জামদানি বানিয়ে প্রতি শাড়িতে আয় হয় গড়ে ৫শ থেকে ১৫০০ টাকা— অথচ বাজারে সেটি বিক্রি হয় ১০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত। মধ্যস্বত্বভোগী ও ব্র্যান্ডিং সংকটে তারা অনেকেই ঋণগ্রস্ত।

জামদানি এখন শুধু বাঙালি নারীর গর্ব নয়, ইউনেস্কো স্বীকৃত ‘মানবতার অমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’।

যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, জাপান, মধ্যপ্রাচ্যসহ বহু দেশে এই শাড়ির রপ্তানি হচ্ছে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে ব্র্যান্ডিং দুর্বল হওয়ায় কারিগররা লাভবান হতে পারছেন না।

জামদানি শুধু কাপড় নয়, এটি এক সংস্কৃতি। এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে দরকার রাষ্ট্রীয় সহায়তা, কারিগরদের প্রশিক্ষণ, ও আধুনিক বিপণন কৌশল।

আধুনিকতার জোয়ারে জামদানি যেন হারিয়ে না যায় এ ব্যাপারে সরকারের প্রতি আকুল আবেদন জানিয়েছেন জামদানি শাড়ি শিল্প তাঁতিগোষ্ঠী।

এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।