ঢাকা, সোমবার, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ২০ মে ২০২৪, ১১ জিলকদ ১৪৪৫

ফিচার

ওরা প্লেন দেখতে আসে

খায়রুল বাসার নির্ঝর, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৫৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ৮, ২০১৫
ওরা প্লেন দেখতে আসে ছবি: নূর- বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

“মা দ্যাখছো?”—যে লোকটা বলছে তার পরনে কম পয়সার সাদা শার্ট অনেকবার ধোয়ার ফলে নেতানো কেমন যেন! তবু যতটা সম্ভব পরিপাটি ইন। জুতায় ধুলোর আস্তরণে কালো রঙ এখন ফ্যাকাশে।

গোলগাল চশমা, চোখের নিচের স্পষ্ট কালচে ছাপ বয়স লুকাতে ব্যর্থ। চল্লিশ পেরিয়ে আরো বাড়তি পাঁচ ছুঁইছুঁই—অনুমানে মেপে ফেলা যায়।



এ শহরে এমন মানুষের সংখ্যা অগুনতি, যারা শহরে থেকেও শহর থেকে বিচ্ছিন্ন। শহর তাদের আপন করেনি, অথবা তারাই শহরকে। একটা ছোট্ট চাকরি করতে হয় বলে করা, থাকতে হয় বলে থাকা। কিন্তু তাদের কাজ কিংবা থাকা কোনোভাবেই শহুরে হয়ে ওঠে না। সারাজীবনেও। শপিং কমপ্লেক্স তাই তাদের নয়, সারি সারি চাইনিজ-থাই রেস্টুরেন্ট তাদের নয়, পার্ক, ক্লাব, ফুডকোর্ট, দশতলার আকাশ—কিছুই নয়। এমনকি উঁচু উঁচু বিলবোর্ডও নয়।



এ মানুষটিও ওই শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী একজন।

মাকে অনেকটা ধারাভাষ্যের মতো করে বুঝিয়ে দিচ্ছে—
: ওই প্লেনটা দেখতেছো না? ওইটা এখন উড়াল দিবে, দেখতে পারতেছো?
: এই যে দ্যাখো, লাইট জ্বলতেছে, এখন একটা প্লেন আসবে। তুমি এইখানটায় খাড়াও।

মায়ের ধূসর দৃষ্টি ঘুরে ঘুরে দেখে। জগতের বিস্ময় নেমে আসে তার বয়স্ক চোখে, “এত্তো বড়!” দু’হাত কাঁটাতারে পাশাপাশি রেখে চিবুক ঠেকিয়ে দেয় মাঝখানের ফাঁকা জায়গাটায়। তার হয়ত চিন্তা হচ্ছে, এত বড় শরীর নিয়া প্লেনডা ক্যামনে ওড়ে!



হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পেছন দিকটায়, বাউনিয়া জুড়ে প্রথমে ধীরে ধীরে, এবং পরবর্তীতে হঠাৎই বিকেল নেমে আসার খানিক আগে থেকে দলে বলে লোক আসতে থাকে। সরু রাস্তার দু’পাশে, এমনকি মাঝখানটায়ও তারা অবস্থান নেয়। মূল রানওয়েকে খানিক পেছনে রেখে, অনেকগুলো সিগনালবাতি একসঙ্গে জ্বলে উঠলে তারা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। অতি দূর থেকে বিমান ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে কাছে আসতে থাকে। খানিক পরপর। তখন দাদা তার ক্লাস ওয়ান-বয়সী নাতিকে কাঁধে ওঠায়। বলে, “এখন তোরে প্লেনে চড়ামু। ” নাতি কান্দার মতো করে। সে প্লেনে চড়তে চায় না। দাদার কান্ধেই থাকতে চায়। দাদার মাথার প্রায় সাদা চুল দু’হাতে শক্ত করে ধরে, প্লেন পড়া দেখতে চায়।



এই গ্রাম থেকে ছেলেকে দেখতে সদ্য শহরে আসা বৃদ্ধা, ওই নাতি, কিংবা তার দাদা—শুধু এরাই তো নয়। বাউনিয়ার এয়ারপোর্টের পেছনের ওই অংশটায় প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ আসে। তাদের একটাই শখ, ক্যামনে প্লেন ওঠে-নামে, দেখা। কেউ কেউ, আশপাশে যাদের বাড়ি, হয়ত প্রতিদিনই আসে। ‘আজব’ দৃশ্য প্রতিদিন দেখার মধ্যে দোষের কিছু নাই! ফলে জায়গাটি এখন বিনোদন স্পট। অনেকগুলো ফুচকা-চটপটির টং, আইসক্রিমের যাযাবর ভ্যান, বাদামওয়ালা, আমড়া সাজিয়ে বৃদ্ধা, চা-সিগারেটওয়ালা মানুষটা দিনভর বসে থাকে। ওদের বেচাবিক্রিও বেশ ভালো।



যারা এখানকার দর্শনার্থী, বেশিরভাগই বৃদ্ধা, অথবা বার্ধক্যের কাছাকাছি, আর শিশু। আর এদের বেশিরভাগ নয়, বলা চলে সবাই নিম্নমধ্যবিত্ত। এরা ‘নগরায়নের জঞ্জাল’! এরা বাসস্টপেজের আসন দখল করে বসে থাকে! ফুটপাতে-ওভারব্রিজে ভিড় বাড়ায়! সুসজ্জিত উঁচু উঁচু বিল্ডিংসমৃদ্ধ রেসিডেনশিয়াল এরিয়া কালচারের পাশে নোংরাপাড়ায় ভাড়া থেকে সৌন্দর্য নষ্ট করে! এদের জন্য তাই শহর—শোয়ার জায়গাটুকু ছাড়া বাকি কোনোকিছুতেই প্রবেশাধিকার দেয়নি।



এদের বিনোদনের কোনো জায়গা নেই। ছুটির দিনে পরিবার নিয়ে একসঙ্গে একটু বেরুবার পথ বন্ধ করেছে শহর। বদলে যে পথগুলো খুলে রেখেছে, তার একদিনের খরচে, পুরো মাস কাবারের চিন্তা করতে হয় তাদের। শিশুদের নির্মল বিনোদনের-বিকাশের স্পট এ শহরে ক’টা আছে? আর বৃদ্ধদের জন্যও কি? আছে বুঝি একমাত্র বৃদ্ধাশ্রম!



যেহেতু থাকে না, মানুষ তাই পথ খুঁজে নেয়। খুঁজে নিয়েছে যেমন বাউনিয়ার এ জায়গাটি। যেখানে ‘এত্তো বড়’ প্লেন, মাথার একটু উপর দিয়ে, শোঁ শব্দে কাঁপিয়ে আভিজাত্যের মতো গর্জন তুলে, খুব কাছে নামে। পেটভর্তি যাত্রী নিয়ে উঠে উড়ে যায়। এতে করে এই একটু ঢালু শ্রেণীর আর্থিক-সামাজিক অবস্থানের মানুষের জন্য বিনোদনের একটা চমৎকার জায়গা হয়েছে।



তারা বিকেলে আসে, হৈহৈ করে সময় কাটায়। তারপর সন্ধ্যার একটু আগে-পরে ঘরে ফেরে যখন, হয়ত ভাবতে বসে, হয়ত বৃদ্ধরা না চাইলেও এমনি এমনিই ভাবনায় আসে—ছোটবেলা। একটা খোলা মাঠ। বাড়ির উঠোন। অথবা পথ। গর্জন তুলে একটা বিমান উড়ে চলে যাচ্ছে কোথায় কোথায়! আর তারা একপাল দস্যি ছেলের দল ছুটছে। এভাবেই হয়ত মাঝেমধ্যে পায়ের নিচে সরে সরে গেছে গ্রামের পর গ্রাম।



অনেকদিন পর হয়ত বৃদ্ধের মনে পড়ে, সে আসলে একদিন পাইলট হতে চেয়েছিল! আর যাদের এখনো স্কুল-বয়স। বাবার হাত ধরে-দাদার কাঁধে চড়ে ‘এত্তো বড়’ প্লেন দেখে এসেছে, হয়ত তাদের এইম ইন লাইফে গোপনে ঢুকে পড়ে, “মা, প্লেন চালানো খুব কঠিন, না?” ঠিক ওই শিশুটির মতো, এই মুহূর্তে যে মায়ের হাত থেকে একেকটা করে খোসা ছাড়ানো বাদাম নিয়ে মুখে পুরছে। আর সন্ধ্যা ডেকে এনে চারপাশে জড়ো করছে বাউনিয়ার বিকেল।

বাংলাদেশ সময়: ১২৫০ ঘণ্টা, নভেম্বর ৮, ২০১৫
কেবিএন/টিকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।