ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

‘গৌরনদীর দই, একবার পাইলে আর একবার কই’

মুশফিক সৌরভ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭১৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১১, ২০১৫
‘গৌরনদীর দই, একবার পাইলে আর একবার কই’ ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বরিশাল: ‘গৌরনদীর দই, একবার পাইলে আর একবার কই’। বরিশালের ঐতিহ্যবাহী ‍এ দই যারা একবার চেখে দেখেছেন তাদের কাছে এ প্রবচনের মর্মার্থ ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই।



তবে গৌরনদীর দইয়ের মজা কি মাজেজা যারা জানেন না, উপরের প্রবাদের সত্যতা যাচাইয়ে তাদের এর স্বাদ চেখে দেখার বিকল্প নেই।

বিশেষে করে ভোজন বিলাসীদের ভোজন-রসনার ঘোষকলা পূর্ণ করতে বরিশালের গৌরনদীর দইয়ের জুড়ি মেলা ভার।

ঐতিহ্যগত কারণে সুদীর্ঘকাল ধরে বিশেষ রসনার জায়গা দখল করে আছে গৌরনদীর দই ও মিষ্টি। আঞ্চলিক ও দেশের গণ্ডী পেরিয়ে এর সুনাম দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে।

নানা প্রতিকূলতা পাড়ি দিয়ে ঐতিহ্য রক্ষা করে দই ও মিষ্টি তৈরির এ পেশা টিকিয়ে রেখেছেন গৌরনদীর কয়েকজন মিষ্টি ব্যবসায়ী। বংশ পরম্পরায় তারা উৎপাদন করে চলেছেন জিভে জল এনে দেওয়া দই।

তবে পরিচিতি ও চাহিদা বৃদ্ধির কারণে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী অধিক মুনাফার লোভে গুণগত মান নষ্ট করে কৃত্রিমভাবে দই উৎপাদন করছেন। যা গৌরনদীর দইয়ের মান সম্পর্কে বিভিন্ন নেতিবাচকতা তৈরি করছে।

দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশ-বিভূঁইয়ের বাঙাল মুল্লুকে যে দইয়ের এতো সুনাম, তার খোঁজ নিতেই বাংলানিউজের অনুসন্ধান।
 
বরিশাল মূল শহর থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরের শহর গৌরনদী। বাসস্ট্যান্ড থেকে নেমেই কয়েক পা দূরত্বে ডান দিকে মোড় নিয়ে ছোট গলিপথ। ওই পথ ধরে সামনে এগুতেই গৌরনদী থানার উত্তর পাশেই গৌরনদী বন্দর।

এর পাশ ঘেঁষে গৌরনদী উপজেলা বাজারের দুধপট্টি। এখানকারই কয়েকটি মিষ্টির দোকানে উৎপাদিত হয় বিখ্যাত এ দই।

বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সকাল থেকে রাত অব্দি এ বাজারে মণকে-মণ গরুর দুধের বিকিকিনি চলে। অনেকটা ওই দুধ দিয়েই তৈরি হয় এখানার দই ‍ও মিষ্টি।

সাত-সকালে, ৮টার দিকে বাজারে প্রবেশ করেই ঠাঁওর করা মুশকিল এর গুরত্ব। অথচ সারাদিন ঝিমুনি ধরা এ বাজারের কয়েকটি মিষ্টির দোকান থেকেই প্রতিদিন গোটা দক্ষিণাঞ্চল ও দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে শত শত হাঁড়ি দই।  

আশপাশ ঘুরে দেখা মিললো ছোট-বড় বেশ কয়েকটি দই কারখানার। সেগুলোর একটি বাদে সবকয়টিতে মেশিনের আধ্যিপত্য।

কথা বলে জানা গেলো, সুদীর্ঘকাল থেকে পারিবারিক পেশার অংশ হিসেবে এখানে দই উৎপাদন করে আসছে কয়েকটি পরিবার।

তারাই দক্ষতা ও নিপূণতা দিয়ে ধরে রেখেছেন গৌরনদীর দইয়ের ঐতিহ্য ও স্বাদ। এদের মধ্যে রয়েছেন গৌরনিতাই মিষ্টান্ন ভান্ডারের স্বত্ত্বাধিকারী শচীন্দ্র নাথ ওরফে শচীন ঘোষ, শ্রী দূর্গা মিষ্টান্ন ভান্ডারের গৌরাঙ্গ দাস ও শ্রী গুরু মিষ্টান্ন ভান্ডারের সুশীল ঘোষ।

কথা হলো গৌরনদীর দইয়ের অন্যতম কুশীলব সুশীল ঘোষের সঙ্গে। জানালেন, বংশ পরম্পরায় তারা এ পেশা ধরে রেখেছেন। তার দাদা বলমালী ঘোষ শুরু করেন দই উৎপাদনের এ পেশা। এরপর এটা ধরে রাখেন তার বাবা  বলরাম ঘোষ। তৃতীয় প্রজন্মের উত্তরাধিকার হিসেবে তিনিও ধরে রেখেছেন বাপ-দাদার পেশা।

তিনি জানান, হাজারো প্রতিকূলতার মধ্যেও তারা এ পেশা ধরে রেখেছেন। মূলত ঐতিহ্যের কথা চিন্তা করেই অন্যান্যরা মেশিনে দই উৎপাদন করলেও তিনি এখনও সনাতন পদ্ধতিতেই দই উৎপাদন করছেন। ফলে উৎপাদন খরচ বেশি হচ্ছে তার।

সুশীল ঘোষ জানান, প্রতিদিন দই উৎপাদনের জন্য তার প্রায় ৫০ মণ গরুর দুধের প্রয়োজন হয়। এর থেকে ২০ মণের মতো দই উৎপাদিত হয়। সেইসঙ্গে তৈরি করেন বাহারি নকশা ও স্বাদের মিষ্টি।

দুধ সংগ্রহ থেকে শুরু করে দই উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ পর্যন্ত অন্তত দৈনিক ৭০ জন লোক কাজ করেন তার ‍এখানে। এদের কারো দৈনিক, কারো কারো মাসিক ভিত্তিতে মজুরি দেওয়া হয়।

তার কাছে জানতে চাওয়া হয় দই উৎপাদনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে। তিনি জানান, প্রথমে সংগ্রহকৃত গরুর দুধ বড় কড়াইতে নিয়ে ভালোভাবে মাটির চুলাতে রেখে জ্বাল দেওয়া হয়। এরপর তা ঠাণ্ডা করা হয়। কড়াইয়ের ভেতর থেকে বাঁশের চাক দিয়ে নির্দিষ্ট পরিমাণে মাখন তুলে ফেলা হয়।

এরপর কড়াইয়ে দুধের যে অংশ থাকে তার সঙ্গে চিনি মিশিয়ে আবারো ভালোভাবে গরম করা হয়। এবার মিশ্রণের রং কিছুটা লালচে আকার ধারণ করলে তা নামিয়ে ফেলা হয়।

এরপর ওই মিশ্রণ মাটিতে সাজিয়ে রাখা বিভিন্ন আকৃতির (১ কেজি থেকে ৬ কেজি) মাটির হাঁড়িতে ঢালা হয়। এভাবে দই পাতা হয়। এ প্রক্রিয়াকে বলা হয় চাণক।

এভাবে হাঁড়িতে পেতে রাখা দই এভাবে চারপাশে কচুরিপানা দিয়ে ‍তার ওপর ২৪ থেকে ৩০ ঘণ্টা রাখার পর তা অকেটা জমাট ও কিছুটা শক্ত হয়ে আসে। এরপর শুরু হয় তা বিক্রি ও বাজারজাতকরণের কাজ।

এই দই আবহাওয়া ও তাপমাত্রা ভেদে ৬ থেকে ১০ দিন পর্যন্ত ভালো থাকে।

সুশীল ঘোষ আরো জানান, প্রতিকেজি দই ১২০ টাকা দরে বিক্রি করেন তারা। এছাড়া চাহিদা অনুযায়ী নিজস্ব পরিবহনে করে দূর-দূরান্তে পাঠানো হয় এই দই।

স্থানীয় দই উৎপাদকরা জানান, ১৯৭৪ সালে ঘোষদের জন্য রেশম পদ্ধতি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকে সরকারি-বেসরকারি কোনো সহযোগিতা পাচ্ছেন না তারা।

ফলে বর্তমানে নানা কারণে উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। দুধের চড়া দাম, ঘর ভাড়া, বিদ্যুত বিল, জ্বালানি, কর্মচারীদের বেতনসহ নানা কারণে ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় এ ব্যবসায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই সহজ শর্তে ঋণ বিতরণ, দুধের বাজার, ডেইরি ফার্ম স্থাপন এখন জরুরি হয়ে পড়েছে তাদের জন্য।

সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা  পেলে ও ছোট-খাটো দোকানে কৃত্রিমভাবে দই উৎপাদন বন্ধ করা গেলে তারা এ পেশার বিস্তারসহ সার্বিক উন্নতি নিশ্চিত করতে পারেন। এ জন্য সংশ্লিষ্টদের সুদৃষ্টি কামনা করেন তারা।

বাংলাদেশ সময়: ০৭০৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১১, ২০১৫
এসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।