জলের সাথে আছে জলের গভীর পরিচয়,
সমুদ্র তাই ঐক্যবদ্ধ, পাহাড় ততো নয়।
পাহাড় হলো একটা থেকে অন্যটা বেশ দূরে,
কিন্তু সাগর মহাসাগর বাঁধা একই সুরে।
নদীর বুকে এলোমেলো জলরাশির ছুটোছুটি তো নদীমাতৃক বাংলাদেশের চিরচেনা চিত্রকল্প। এখানে জলের সঙ্গে জলের গভীর পরিচয়-তাইতো নদী, সাগর, মহাসাগর। বাঙালির সঙ্গে জলের পরিচয়- সেতো জন্ম জন্মান্তরের। বাঙালির জন্ম, শৈশব, বেড়ে ওঠা সবই তো নদীর জল গায়ে মেখে।
ব্যাঙের সমুদ্র দর্শনের কল্পকাহিনী আমাদের জন্য সত্য নয়। বাঙালি পাত কুয়ার ব্যাঙ নয় যে সে এক ঘটি জলে সমুদ্র দেখবে। বাঙালির জন্ম স্নানও যে নদীর জলে। তাইতো নদীর বুকে নাও ভাসিয়ে বাঙালির সাগর সঙ্গম নতুন কিছু নয়। নদীর মোহনা পেরিয়ে মাঝ দরিয়ায় গলা ছেড়ে ভাটিয়ালি গাওয়া জাতি-আদতে ‘সমুদ্র সন্তান’। আমাদের জীবন তাই সাগর মহাসগারের মতো একই সুরে বাঁধা।
বিস্তীর্ণ বালুকাময় তীরে দাঁড়িয়ে, ছবি একে যাওয়া ঝাউবনের দেয়ালে হেলান দিয়ে অথবা আকাশ থেকে এইমাত্র ঝুলে পড়া রক্তিম সূর্যকে হাতের মুঠোয় নিয়ে সমুদ্র দর্শন আমাদেরই শোভা পায়।
প্রকৃতি এখন শীতল চাদরে মোড়া। সমুদ্রও তাই শীতল পাটিতে মোড়া প্রশান্ত এক জলরাশি। মায়াবি আচলের মতো আছড়ে পড়ছে তার ঢেউ। অপরাহ্নের আধো আলো ছায়ায় খেলা করে তার ঘনকালো কেশরাশি। সমুদ্র কন্যার এমন মায়াবি রূপে বিমোহিত হতে নেই কোনো মানা।
এখন শীতের শেষ বেলা। সমুদ্র কন্যা কক্সবাজারে এখন এমনই মায়াবী সৌন্দর্য বিরাজ করছে।
শৈশবে দেখা একটি পোস্টারের কথা খুব মনে পড়ে। বিশাল এক সমুদ্র। তারই মাঝে ছোট এক নৌকা। সেই পোস্টারের নীচে লেখা আছে ‘ O God, Your Sea is So Big, My Boat is So Small’। কথাটি এখনও মনে পড়ে। আমার কাছে এটিকে একটি ‘প্রশংসাসূচক প্রার্থনা’ মনে হয়েছে। একই সঙ্গে সাগরের অপার সৌন্দর্য ও বিশালত্বের কথা ও সাগরের বুকে ভেসে থাকার অস্ফুট প্রার্থনা।
দৃষ্টির শেষ সীমানায় সাগরের বুকে ভেসে থাকা সাম্পান যেন সেই অপূর্ব চিত্রপট। সৃষ্টিকর্তার প্রিয় রঙে আঁকা কোনো ছবি।
সমুদ্র দর্শনে প্রশস্ত হয় হৃদয়, প্রশান্ত হয় আত্মা। উপলব্ধি জাগে নিজের ক্ষুদ্রতার। সৃষ্টির বিশালত্ব ছবি আঁকে হৃদয়ে।
কক্সবাজারতো শুধু সমুদ্র কন্যাই নয়। পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতও। দেশের সবচেয় স্বাস্থ্যকর স্থানও কক্সবাজার।
ইতিহাসে কক্সবাজার এক সময় পানোয়া নামেও পরিচিত ছিল। যার অর্থ নাকি হলুদ ফুল। কক্সবাজারে তেমন কোনো হলুদ ফুল চোখে পড়েনি। সবুজ পাহাড় আর নীল সমুদ্রই কক্সবাজারের সৌন্দর্যের আধার। কক্সবাজারকে একসময় ‘পালঙ্কি’ নামেও ডাকা হতো। ডুলহাজরা-যার অর্থ হাজার পালঙ্কি। কক্সবাজার এখন হাজার সৌন্দর্যের লীলাভূমি-হাজার পালঙ্কি। ডুলহাজরার সাফারি পার্কও আজ কক্সবাজারের অন্যতম পর্যটন স্পট।
শুধু দীর্ঘ সৈকতই নয়। এখানে পসরা সাজিয়ে বসেছে অসংখ্য দোকানি। দেশি আর বার্মিজ পণ্যের সম্ভারে ঠাসা সব দোকান।
একই জায়গায় পাহাড় আর সমুদ্রের এমন সৌন্দর্য বিশ্বে বিরল। পাহাড়ের সমুদ্র দর্শন-প্রকৃতির এক অপার মহিমা। শুধু পাহাড়ই নয়, আছে ঝর্নাও। কক্সবাজার শহর সৈকত থেকে মাত্র ১৮ কিলোমিটার দূরেই রয়েছে হিমছড়ি।
ডানে সমুদ্র আর বামে পাহাড় নিয়েই হিমছড়ি যাওয়ার পথ। একই পথ ধরে আরেকটু এগিয়ে গেলেই ইনানি সৈকত। এখানেই শেষ নয়। ১২৫ কি. মি. সৈকতের ভাজে ভাজে লুকিয়ে আছে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য। তার কতটুকু আমরা সন্ধান করতে পারছি?
কক্সবাজারকে ঘিরে রয়েছে আরো বিস্ময়। সেন্টমার্টিন এক অবারিত সৌন্দর্যের দ্বীপ। আকাশ আর সমুদ্রের এক মহামিলন ঘটেছে এই দ্বীপে। মাত্রা ১৭ বর্গ কিলোমিটারের একটি প্রবাল দ্বীপ অসীম সম্পদের আধার।
কক্সবাজার কেন্দ্রিক আরো অনেক পর্যটন স্পট রয়েছে। ডুলহাজরার বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক, পাহাড়ি দ্বীপ মহেশখালী, রামু, সোনাদিয়া দ্বীপ, কুতুবদিয়া দ্বীপ, বৌদ্ধ মন্দির, কানারাজার গুহা, মুহুরী, বাঁকখালী, নাফ নদী, মাতার বাড়ি, শাহপরী ও রাখাইন পল্লী ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
কিন্তু এতো সৌন্দর্যের আধার যে কক্সবাজার তার প্রতি আমাদের অবহেলার অন্ত নেই। পর্যটনের অপার সম্ভাবনাময় এ জেলায় নেই কোনো বিশেষ কার্যক্রম। সরকারি কোনো কার্যক্রম চোখে পড়েনা। যততত্র বিলাস বহুল আবাসিক হোটেল গড়ে ওঠাই পর্যটনের একমাত্র লক্ষণ নয়। যে যার মতো জমি দখল-বেদখল করে গড়ে তুলছে আবাসিক হোটেল আর রেস্টুরেন্ট। নেই কোনো দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। সাগরের পাড়েই গড়ে উঠছে এসব স্থাপনা।
সরকারি কোনো নিয়ম-নীতি নেই। থাকলেও তার কোনো প্রয়োগ চোখে পড়েনা। সাগরের কতটুকু দূরে এসব স্থাপনা করা যাবে তাও স্পষ্ট নয়।
কক্সবাজার নিয়ে আমাদের কোনো সমন্বিত পরিকল্পনা নেই। এর আশপাশের অন্যান্য পর্যটন কেন্দ্র নিয়ে যদি আমরা একটি পর্যটন জোন করতে পারতাম তবে বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনা হতো। আমার দুই দিনের সমুদ্র দর্শনে কোনো বিদেশি পর্যটক চোখে পড়েনি। এর মূল কারণ, প্রকৃতি আমাদের সম্পদ দিয়েছে। কিন্তু আমরা তার ব্যবহার ও বিস্তার করতে পারিনি।
শুধু সাগর দেখার জন্য বিদেশি পর্যটকরা কোথাও যায়না। তাদের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা চাই। বিচ বা সৈকতে নেই কোনো শৃঙ্খলা। ১২৫ কি. মি. সৈকতে তাদের জন্য আমরা কোনো ব্যবস্থা করতে পারিনি। অপরিচ্ছন্ন সৈকত কখনো পর্যটক আকর্ষন করতে পারেনা।
এখানে নেই অন্য কোনো বিনোদনের ব্যবস্থা। ভালো কোনো সিনেমাহলও নেই। সন্ধ্যা হলে হোটেলে দরজা বন্ধ করে সিরিয়াল দেখা ছাড়া আর কোনো বিনোদনের ব্যবস্থা নেই। এদিকে সেন্টমার্টিনে নেই কোনো মানসম্পন্ন হোটেল। বিদ্যুৎ তো নেই-ই।
মহেশখালিরও একই অবস্থা। মহেশখালিতে যাওয়ার জন্য স্পিড বোট আছে ঠিকই কিন্তু আধুনিক কোনো জাহাজ নেই। মহেশখালিতে থাকার জন্য কোনো আধুনিক হোটেল নেই। অথচ মহেশখালির পুরো সৌন্দর্য দর্শনের জন্য একদিন যথেষ্ট নয়। রাতে থাকার জন্য কোনো ভালো ব্যবস্থা নেই। অব্যবস্থাপনা ও অযত্নের ছাপ সর্বত্র। মহেশখালি একমাত্র দ্বীপ যেখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়। কিন্তু মুখ থুবড়ে পড়েছে পর্যটন সম্ভাবনা।
কক্সবাজারে যাওয়ার জন্য যে সড়ক রয়েছে তা প্রশস্ত নয়। পর্যটন বর্ষে কক্সবাজারে যাওয়ার সড়কের এমন বেহাল দশা ‘গোড়াতেই গলদ’ নয় কী! রেল লাইন থেমে গেছে দোহাজারি গিয়ে। রেল গেলে কক্সবাজারের সম্ভাবনা আরো বেড়ে যাবে।
তাই পর্যটনের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারিভাবে যারা জড়িত তারা কক্সবাজারের পর্যটন সম্ভাবনাকে গুরুত্ব দিয়ে এব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা করবেন এটাই প্রত্যাশা। যে জাতিকে আল্লাহ প্রাকৃতিক সম্পদ দান করেছেন সেই জাতির প্রতি তার বিশেষ রহমত রয়েছে। আমরা সেই রহমতের সাগরে ভাসছি।
পৃথিবীর কোনো দেশেই এক সঙ্গে এতো সৌন্দর্যের সমাহার দেখা যায়না। আমাদের প্রয়োজন শুধু এ সম্পদের সঠিক ব্যবহার করা। বিশ্বের কাছে তুলে ধরা। আমরা যা ব্যবহার করছি- তা মহাসমুদ্রের এক ঘটি জলের বেশি কিছু নয়। সম্ভাবনা তার চেয়ে ঢের বেশি।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৩৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৯, ২০১৬
এসএইচ