শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার): চা বাগানের সবুজ চা-গাছ আর গাছ থেকে পাতা তোলার সঙ্গে নারীদের সম্পর্ক বহুকালের। তাদের শ্রমমুখর প্রতিটি হাতের নিবিড় স্পর্শে দু’টি পাতা একটি কুঁড়ি সার্থকতা লাভ করে।
ফাল্গুনের সকালেও মৃদু শীতের আমেজ। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে ৮টায় গিয়ে ঠেকেছে। শ্রীমঙ্গল শহরঘেঁষা ভাড়াউড়া চা বাগানের নারী শ্রমিকরা তখন যে যার মতো কর্মব্যস্ত। সংসারের দৈনিক কাজ সেরে বাগানের কাজে ফিরে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। প্রতিটি সকাল এভাবেই তাদের কাছে চঞ্চলতা নিয়ে আসে। নিয়ে আসে কাজে ফেরার তাগিদ।
মঙ্গলবার (৮ মার্চ) সকালে সরেজমিন ভাড়াউড়া চা বাগানের বিভিন্নপ্রান্ত ঘুরে নারী শ্রমিকদের কর্মমুখরতা চোখে পড়ে।
ভাড়াউড়া দক্ষিণ লাইনে দীর্ঘদিন ধরে বসবাসকারী লীলাবতি হাজরার চোখের আলো এখন অনেকটা কমে এসেছে। স্বামী মারা গেছেন অনেক দিন আগে। একমাত্র মেয়েকে দিয়েছেন তার বাগানের স্থায়ী কাজটি। মার পরিবর্তে মেয়েই এখন বাগানের স্থায়ী শ্রমিক।
একমাত্র কুঁড়েঘরটি তাদের দরিদ্রতার সাক্ষী হয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে।
এক মুহূর্তে বুঝতে পারলাম আমার “কেমন আছেন?” প্রশ্নটি তার কাছে অবহেলা আর তিরস্কারের মতো শোনালো।
‘এখনো মেয়েটির বিয়ে দিতে পারছি না! বড় কষ্ট নিয়ে এই আমাদের থাকা। ...’ হতাশার উত্তর।
ভাড়াউড়া পশ্চিম লাইনের বাসিন্দা পঞ্চমী রিকিয়াশরের ঘরে বৃষ্টির যন্ত্রণা! বৃষ্টি হলেই শনবাঁশের ঘরে পানি পড়ে। স্বামী, দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে তার পরিবার। দু’টি মেয়েরই বিয়ে হয়ে গেছে অল্প বয়সেই। তাদের পড়াশোনা প্রাথমিক পর্যন্ত।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠিক সম্পাদক ও শ্রমিক নেতা বিজয় হাজরা বলেন, বাগান ম্যানেজমেন্ট শ্রমিকদের উন্নত আবাসনের প্রতিশ্রুতি দিলেও তা বাস্তবায়ন করছে না। অনেকেই ব্যক্তিগত উদ্যোগে পাকা বাড়িঘর তৈরি করেছেন। কিন্তু গরিব শ্রমিকদের অবস্থা খুব খারাপ। অনেকে তাদের একমাত্র ঘরেটিতে গৃহপালিত পশুদের সঙ্গে পুরো পারিবার নিয়ে গাদাগাদি করে থাকে।
সময় তখন সকাল দশটা। নারী চা শ্রমিকরা সকাল নয়টা থেকে কাজে আসার কথা থাকলেও আজ এখনও আসেননি।
বাগানের সর্দার কমল কেউট বললেন, গতকাল ও আজ শিবচর্তুদর্শীর উৎসব চলছে। তাই একটু দেরি হচ্ছে আসতে।
চা বাগানের মোট স্থায়ী শ্রমিক এবং স্থায়ী নারী কত? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানালেন, ৭শ ৭০ জন স্থায়ী শ্রমিক। তার মধ্যে নারী ৪শ জন।
গুলজান বিবি ভাড়াউড়া চা বাগানের একমাত্র নারী সর্দার। এ বাগানে মোট বারোজন সর্দার রয়েছে। সর্দারের প্রধান কাজ হলো শ্রমিকদের নির্দেশ দেওয়া, নিয়ন্ত্রণ ও শাসন করা।
সকাল দশটা নাগাদ নারী চা শ্রমিকরা দুজন-চারজন-ছয়নজন করে করে আসতে শুরু করলেন। কিন্তু গুলজান বিবির তখনও দেখা নেই। শুরু হলো তার জন্য অপেক্ষা। অভিজ্ঞতা বেশি বলে বয়স একটু বেশি হওয়াতেও কর্তৃপক্ষ তাকে বাদ দেয়নি; শ্রমিক সর্দার হিসেবে দায়িত্বে রেখেছে।
প্রতীক্ষার প্রহর পেরিয়ে সাড়ে দশটায় সর্দার গুলজার বিবি এলেন। কতদিন ধরে এ কাজের সঙ্গে জড়িত এমন প্রশ্নের উত্তরে জানালেন, প্রায় ষাট বছর। কথা প্রসঙ্গে তিনি আরও জানালেন, তার দলে পঞ্চাশ জন স্থায়ী নারী শ্রমিক রয়েছেন।
ভাড়াউড়া চা বাগানের ১ নম্বর সেকশনে দ্বিতীয় রাউন্ড পাতা তোলা (প্লাকিং) হচ্ছে। সর্দার গুলজার বিবি তার দলের প্রধানদের বুঝিয়ে দিলেন কতটুকু পরিমাণ পাতা আজ তুলতে হবে।
ঘন সবুজ চা বাগান। কাছ থেকে যত দূর চোখ যায়- তাতে দু’টি পাতা একটি কুঁড়ির আধিপত্য। নারী চা শ্রমিকরা পরম মমতায় সেগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে সংগ্রহ করেছেন।
কী অপূর্ব সেই সংগ্রহদৃশ্য! চোখ জুড়িয়ে যায়! মন সজিব হয়। হৃদয় প্রার্থনারত হয় - এভাবেই যুগ যুগ পরম মমতা আর ভালোবাসায় টিকে থাকুক আমাদের সুপ্রাচীন চা শিল্প, আর আমাদের চায়ের নারীরা।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৫ ঘণ্টা, ০৮ মার্চ ২০১৬
বিবিবি/এএ