মানুষ মাত্রই ভুল করে। সেই ভুল করাদের মধ্যে আছে প্রাইমারি ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চের অমনোযোগী ছাত্র থেকে সর্বকালের সেরা মেধাবী পর্যন্ত।
আবিষ্কারক হিসেবে টমাস আলভা এডিসন বানিয়েছেন অনেক অনেক যন্ত্র, কিন্তু বৈদ্যুতিক বাতির একটা কার্যকর সংস্করণ বানাবার জন্য তিনি প্রায় এক হাজার বার চেষ্টা করে তবেই সফল হয়েছিলেন। সফল হওয়ার পর তাকে যখন প্রশ্ন করা হয় এই অসংখ্য ব্যর্থতার জন্য, তিনি অবাক হয়ে বলেছিলেন, কই আমি তো ব্যর্থ হইনি। বরং ইলেক্ট্রিক বাল্ব কিভাবে বানানো যায় না তার ৯৯৯টা কায়দা হাতেনাতে দেখিয়েছি।
আবার বিজ্ঞানী আইনস্টাইনেরও ভুলের সংখ্যা কম নয় মোটেও। তার বিখ্যাত সমীকরণ E=MC2 সূত্রও প্রমাণ করেছিলেন বেশ কয়েকবার ভুল করে। আবার কিছুদিন আগে বিজ্ঞানীরা মহাকর্ষীয় তরঙ্গের অস্তিস্ব প্রমাণ করে আইনস্টাইনের ধারণাকে সঠিক বলে প্রমাণ করলেও প্রথম প্রথম আইনস্টাইন নিজেই বেশ দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলেন মহাকর্ষীয় তরংগের অস্তিত্ব নিয়ে। দ্বিধাটা এতই বেশি ছিল যে, মহাকর্ষীয় তরংগের অস্তিস্ব নাই লিখে উনি একটা রিসার্চ পেপার জমাই দিয়ে দিয়েছিলেন। তার এক সায়েন্টিস্ট বন্ধু সেই পেপারের ভুলটা পাবলিকেশনের জন্য প্রেসে যাওয়ার আগে ধরিয়ে দিলে আইনস্টাইন তা সংশোধন করে নেন।
এরকম অনেক ভুল নিজের জীবনকালে সংশোধন করতে পারলেও দুইটা ভুল তার বিজ্ঞানী জীবনে বেশ মোটা দাগ কেটে আছে এখনো। কোয়ান্টাম মিকানিক্স ভালভাবে বুঝেন না সেরকম বিজ্ঞানীদের সংখ্যাও নেহায়েত কম না।
কোয়ান্টাম মিকানিক্সের অগ্রযাত্রায় আইনস্টাইনের নোবেলজয়ী আবিষ্কার ফটোইলেকট্রিক এফেক্টের দারুণরকম প্রভাব থাকলেও কোয়ান্টাম মিকানিক্স নিয়ে আইনস্টাইনের নিজের মাঝেই দ্বিধাদ্বন্দ্বের অন্ত ছিলনা।
পদার্থবিজ্ঞানের পরিচিত অনেক কিছুর সাথেই এই কোয়ান্টাম মিকানিক্সের কোন মিল নেই। যেমন আমরা কখনো একটা দেওয়ালে হেলান দিতে গিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগি না যে হঠাৎ দেওয়াল ভেদ করে অন্যপাশে চলে যাব, কিন্তু কোয়ান্টামের জগতে এটা খুব নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। সেই জগতে একটা ইলেকট্রন নিত্যনৈমিত্তিকভাবে তার সামনে থাকা দেওয়ালকে ভেদ করে অন্য পাশে চলে যেতে পারে।
আইনস্টাইন তার থিউরি অব রিলেটিভিটিতে দেখিয়েছেন যে, আলোর বেগ সব সময়ই ধ্রুবক। (এমনকি আলোর বেগে চলতে থাকা কোন মহাকাশ যানের পর্যবেক্ষকের কাছেও আলোর বেগ ধ্রুবক থাকবে। যা হল (৩*১০^ ৮)মিটার প্রতিসেকেন্ডে। ) এবং আলোর চেয়ে বেশি বেগে কোন কিছু যেতে পারে না। অথচ কোয়ান্টাম মিকানিক্সের অদ্ভুত এক তথ্যমতে কনিকা একই সময়ে দুইটা ভিন্ন দশায় থাকতে পারে এবং তাদের মধ্যে আলোর থেকেও দ্রুততম বেগে তথ্য আদান প্রদান করা যায়। শেষোক্ত কথাটা পুরোপুরি সত্য হলেও মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইন তার জীবদ্দশায় একদমই মানতে পারেন নি, কারণ তার মতে আলোর চেয়ে বেশি বেগে কোন
কিছু যেতেই পারে না কখনো।
আইনস্টাইন জেনারেল রিলেটিভিটি প্রবন্ধে তার আপেক্ষিকতার সূত্রকে মহাবিশ্বের জন্য সার্বজনীন রূপ দিতে গিয়ে দেখেন যে, এই মহাবিশ্বের গ্রহ নক্ষত্রে যদি গ্রাভিটির পরিমাণ বেশী থাকতো, তাহলে গ্রহ নক্ষত্র সব মহাকর্ষীয় আকর্ষণের জন্য একটা একটাকে আকর্ষণ করে একীভূত হয়ে যেত, মানে চন্দ্র সূর্য পৃথিবী মংগল সব একসাথে মিশে আমাদের মোটামুটি কেয়ামত হয়ে যেত। কিন্তু সেরকম কিছু হচ্ছে না দেখে তার ধারণা হলো- মহাবিশ্ব অসম্প্রসারণশীল এবং স্থির হয়ে আছে। আর এই স্থির হওয়া মহাবিশ্বকে ব্যাখ্যা করার জন্য তিনি একটা ইকুয়েশন লিখলেন, যেখানে তিনি একটা ধ্রূবক টানলেন- যার কাজ হলো এন্টি গ্রাভিটির মতো কাজ করা এবং এই মহাবিশ্বটাকে স্থির রাখা। আর নাম দিলেন কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্ট। সূচিত করলেন ল্যামডা(Λ) দিয়ে।
কিন্তু অল্প কিছুদিন পর বিজ্ঞানী এডউইন হাবল তার বিশাল এবং বিখ্যাত হাবল টেলিস্কোপ দিয়ে প্রমাণ করলেন যে, মহাবিশ্ব সম্প্রসারণশীল। মানে মহাবিশ্বের সকল গ্রহ নক্ষত্র একটা আরেকটার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। বিজ্ঞানী হাবলের এই আবিষ্কার আইনস্টাইনকে বেশ বেকায়দায় ফেলেছিল তখন।
তারপরও বেশ কয়েকবছর গবেষণা করে আইনস্টাইন হাবলের আবিষ্কারকে মেনে নিলেও
বলতে বাধ্য হলেন, কসমোলজিক্যাল ধ্রবক তার জীবনের সবথেকে বড় ভুল ছিল। যেটা আইনস্টাইনের “Biggest blunder of my Life” নামেই পরিচিত এখনো।
প্রসূন ঘোষ রায়: মাস্টার্স স্টুডেন্ট (রসায়ন), সেন্ট জোন্স ইউনিভার্সিটি, নিউ ইয়র্ক
বাংলাদেশ সময়: ০৪৪২ ঘণ্টা, মার্চ ১০, ২০১৬
জেডএম/