বাঘা (রাজশাহী) থেকে ফিরে: স্বর্ণরাঙা মুকুলগুলো ক’দিন আগেও গাছের শাখা প্রশাখায় ঝলমল করছিল। মুকুলের মৌ মৌ গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে উঠেছিল গ্রামের সবুজ প্রকৃতি।
গাছের শাখে শাখে এখন দানা বেঁধেছে গুটি। আর সেই গুটিতেই স্বপ্ন বাঁধতে শুরু করেছেন কৃষক। আবারও প্রহর গুণতে শুরু করেছেন স্বপ্ন সোপানের এই অভিযাত্রীরা। চলছে যত্ন-আত্তি। চৈত্র-বৈশাখেই ফলবতী হয়ে উঠবে গাছ। পরের জৈষ্ঠেই দেবে আম। কৃষককূলে এখন চলছে তারই প্রস্তুতি।
রাজশাহীর বাঘা উপজেলার মণিগ্রাম ঘুরে প্রকৃতির এমনই রূপায়ন দেখা গেছে। চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গাছ, পাতা, মুকুল, গুটি আর আম নিয়ে বাঁধা নানান স্বপ্নের কথা।
আমের রাজধানীখ্যাত রাজশাহীর প্রায় সব এলাকাতেই চাষ হয় লোভনীয় এই ফলের। তবে এরমধ্যে কোন এলাকা প্রথম? জানতে চাইলে সবাই বাঘা উপজেলারই নাম নেবেন। সেই বাঘা উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামে গেলে যে কারোরই মনে হবে যেন আমের রাজ্যে এসে পড়েছেন। এমনই একটি মণিগ্রাম।
রাস্তার চারপাশে যতদূর চোখ যায়, কেবলই মন জুড়ায় আমগাছ। গাছজুড়ে এখন শোভা পাচ্ছে সবুজ সবুজ আমের কাঁচা কাঁচা গুটি। একটি গাছও মিলবে না, যে গাছে আমের গুটি নেই।
রাজশাহীর বাঘার এই গ্রামে আমের বাগানই বেশি। যদিও চারঘাট ও পবা উপজেলায়ও আমের ব্যাপক আবাদ হয়। তবে মিষ্টিস্বাদ, গুণ ও আকারে সেরা বাঘার আমই।
বাঘার মণিগ্রামের চাষি জিন্নাত আলী জানালেন, চাষ এবং ব্যবসা উভয়ের সঙ্গেই তিনি সরাসরি যুক্ত। মূলত পাতা কেনা দিয়েই শুরু হয় আমের কেনা-বেচা। বেশি পাতাওয়ালা গাছে ফলন ভালো হবে ধরে এ পাতা কেনা-বেচা হয়। পাতা কেনা হয় স্থান, ফলনের ইতিহাস আর সম্ভাব্য পরিমাণের ওপর অনুমান করে ব্যবসায়ীরা লোকজনের কাছ থেকে ৩-৪ বছর চুক্তিতে গাছ কেনেন। তারপর থেকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তিনি সেই গাছের মালিক। ফল হলেও তার, না হলেও তার।
গাছপ্রতি এজন্য ৫-১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হয় মালিককে। অবশ্য যুগ যুগ থেকে পাতা কেনার এ প্রথা চলে এলেও এখন অনেকেই ভিন্ন নীতিতে ব্যবসা করেন। আগাম পাতা কেনায় ক্ষতির শঙ্কা থাকে। তাই ব্যবসায়ীরা ধীরে ধীর নিজেরাই বাগান গড়ে তুলেছেন। চাষও করছেন নিজে।
আম ব্যবসায়ী জিল্লুর রহমান জানান, আগে আমের অন ইয়ার অফ ইয়ার থাকতো। অর্থাৎ এক বছর আম হলে অন্য বছর হতো না। কিন্তু ঋতু বৈচিত্র্য ও চাষ পদ্ধতি পরিবর্তনে এখন প্রতি বছরই আমের ভালো ফলন পাওয়া যায়। এজন্য সারাবছরই আমগাছের পরিচর্যা করতে হয়।
এবারের ফলন সম্পর্কে জিল্লুর রহমান বলেন, গত বছর আমের বাম্পার ফলন হয়েছিল। কিন্তু বৃষ্টি কম হওয়ায় প্রচণ্ড খরতাপে গাছেই অনেক আম ফেটে গেছে। এবারও প্রতিটি গাছে মুকুল থেকে গুটি ধরেছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে ভালো ফলন হবে।
জিল্লুর রহমান জানান, বাঘা-চারঘাটসহ রাজশাহীর আমের ব্যবসা সফল করতে এবার স্থানীয় এমপি ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছেন। গতবার রাজশাহীর আমে ফরমালিন আছে বলে যে অপপ্রচার হয়েছিল তা রুখতে শুরুতেই তৎপরাতা শুরু করেছেন তিনি।
এরই মধ্যে আম নিয়ে অপপ্রচার বন্ধে গত ২৯ ফেব্রুয়ারি তার মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন মন্ত্রী। সেখানে রাজশাহীর আম ব্যবসায়ীদের পক্ষ খেকে তিনি প্রতিনিধিত্ব করেন।
এছাড়া গত ১৬ মার্চ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়েও এ বিষয়ে বৈঠক হয়েছে। সেখানেও তিনি ছিলেন। ওই বৈঠকে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, গবেষকরাও ছিলেন। বৈঠকে স্পষ্ট করে জানানো হয়েছে, রাজশাহীর আমে কোনো ফরমালিন ব্যবহার হয় না। সামান্য যে পরিমাণ ফরমালিনের অস্তিত্ব মেলে তা প্রাকৃতিকভাবেই আমের মধ্যেই থাকে, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারাও এই যুক্তিতে মত দিয়েছেন।
একই গ্রামের কৃষক আবদুল মালেক বলেন, বড় ধরনের কোনো প্রকৃতিক দুর্যোগ না হলে লাভের মুখ দেখবেন বাঘার আমচাষিরা। ৯০ শতাংশ আমগাছে মুকুল এসেছিল। সেই মুকুল থেকে গুটি বাঁধতেও শুরু করেছে। বর্তমানে আমের প্রায় আড়াইশ’ জাতের মধ্যে আগাম জাতের ও মধ্যম জাতের আমগাছে গুটি এসে গেছে। দেরিতে গুটি আসবে ফজলি, আশ্বিনাসহ বেশ কয়েকটি জাতের।
তার মতে, আমবাগানে সারাবছর কোনো কাজ থাকে না। তবে মুকুল আসার আগে থেকে গাছের আম নামানো পর্যন্ত এর পরিচর্যার অভাব হয় না। ভালো ফলনের জন্য আমচাষিরা উঠে পড়ে লাগেন। তাছাড়া বাগান ইজারা নিয়েছেন এমন ব্যবসায়ীরা আরও বেশি মনোযোগী হন পরিচর্যায়।
রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. আলিম উদ্দিন জানান, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার গাছে খুব একটা কীটনাশক প্রয়োগের প্রয়োজন নেই।
তবে ছত্রাকজনিত রোগেও আমের গুটি আক্রান্ত হতে পারে। এক্ষেত্রে মুকুল গুটিতে রূপান্তর হওয়ার পর ম্যানকোজেট গ্রুপের ছত্রাকনাশক দুই গ্রাম অথবা ইমাডোক্লোরিড গ্রুপের দানাদার প্রতিলিটার পানিতে দশমিক দুই গ্রাম, তরল দশমিক ২৫ মিলিলিটার ও সাইপারম্যাক্সিন গ্রুপের কীটনাশক প্রতিলিটার পানিতে এক মিলিলিটার মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
রাজশাহী অঞ্চলে প্রায় আড়ইশ’ জাতের আম উৎপন্ন হয়। এবার জাত আম ল্যাংড়া, গোপালভোগ, ক্ষিরসাপাত, বোম্বাই, হিমসাগর, ফজলি, আম্রপলি, আশ্বিনা, ক্ষুদি, বৃন্দাবনী, লক্ষণভোগ, কালীভোগ, তোতাপরী, দুধসর, লকনা ও মোহনভোগ জাতের আম বেশি চাষ হয়েছে। গাছে গাছে বাহারি জাতের গুটি আম এখন দেশের কোটি কোটি মানুষের রসনা মেটাতে প্রস্তুত হচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ০১১৮ ঘণ্টা, মার্চ ২০, ২০১৬
এসএস/এইচএ