ঢাকা: ঘাটপাড়- নামটি রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার অনেকের কাছেই পরিচিত। নাম ঘাটপাড় হলেও আশেপাশে না আছে কোনও নদী বা পুকুর, না আছে কোনও ঘাট।
তবে দূর থেকে দেখলে জায়গাটি আবাসিক এলাকার সাথে ঠিক যেন যায় না, জীর্ণশীর্ণ দেয়াল, কিছুটা মাটির রাস্তা, ডোবার উপর ছোট্ট কাঠের সাঁকো- একদমই যেন উন্নত আবাসিক এলাকার বিপরীত। এই জায়গাটি কুড়িল এবং বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার মাঝে।
ঘাটপাড় নিয়ে এত হৈচৈয়ের কারণ আর কিছুই না, এখানকার খাবারের দোকানগুলো। ভাবলে ভুল হবে যে দোকানগুলো আলিশান কিছু। বরং স্থানটির মতই দোকানগুলোও ছাপড়া। টিনের ছাউনি, কাঠের বেঞ্চ আর প্লাস্টিকের চেয়ার। হালত যখন এই, মেন্যুতে নিশ্চয়ই পিৎজা আর পাস্তা আশা করাটা অবাঞ্ছনীয়! তাহলে বিশেষত্বটা কোথায়?
এটা ধরে নেয়া খুবই স্বাভাবিক যে, দোকানে উঁকি দিলে দেখা যাবে এই স্বল্পখরুচে মেন্যু কেবল যারা কুলাতে পারবেন তারাই বসে খাচ্ছেন। আর ধাঁধাটাও এখানেই। উঁকি দিলে এখানকার বিখ্যাত দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদেরও খেতে দেখা যায়।
এখানে চায়ের দোকান, হালকা সিঙ্গারা, রুটি-কলার দোকান, চানাচুর পাওয়া গেলেও ভাত-খিচুড়ির দোকানই দুপুরে বেশি সরগরম থাকে। দোকানে কর্মরত আবেদকে জিজ্ঞেস করলে জানা যায়, দোকানের মেন্যু হলো সকালে পরাটা, সবজি, ডাল। দুপুরে ভাত, খিচুড়ি, গরু, মুরগি, ভর্তা আর মাছ। রাতে নান, পরাটা, পুরি, মোঘলাই, সবজি আর ডাল। দুপুরের খাবার সময় শুরু হয় ১২/১ টা থেকে ৪:০০-৪:৩০ টা পর্যন্ত। মামাদের ভাষ্য, খাবার শেষ হলে কাস্টমারও শেষ হয়। দোকানে যারা কাজ করেন তারাই ‘মামা’।
দোকানের ক্যাশিয়ারকে বেচা-কেনার কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, “আলহামদুলিল্লাহ, ভার্সিটি খোলা থাকলে বিক্রি ভালো হয়, খাবারের শর্টও পরে। বন্ধ থাকলে যা বানাই, তাই বিক্রি হয়, লস নাই। ”
এর মানে ভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীরা কাস্টমারদের একটি সিংহভাগ দখল করে। দোকানকর্মী আবেদকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, ‘এখানকার খাবারের দাম ছাত্রদের কাছে পছন্দের ও নাগালের মধ্যে তাই। ’
সুমন, রাতুল, আবিদ- তিনজনই ছাত্র, তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা এখানে খেতে বেশ পছন্দ করেন। খাবারের দাম কম এবং সে তুলনায় মান অনেক ভাল। আর দোকানের মামাদের আন্তরিকতাও তাদের এখানে নিয়ে আসে।
আগে এইখানে প্রত্যেকের খাওয়ার জন্য আলাদা পানির গ্লাস ছিলোনা, এখন গ্লাস দেয়া হয়েছে কিন্তু দাম বাড়েনি। এটি তাদের কাছে উল্লেখযোগ্য কেননা তাদের আলাদা কোন ‘সার্ভিস চার্জ’ দিতে হচ্ছেনা।
এখানে দুটি নামকরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস একটি ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ (আইইউবি) অন্যটি নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটি (এনএসইউ)।
নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইলিয়াস আহমেদ, তিনি গত দেড় বছর ধরে এখানে খান, থাকেন মেসে। মেসে রান্না না হলে এখানেই খেতে হয়। নর্থ-সাউথ এর ভেতরের খাবার ব্যায়বহুল এবং পেট ভরে খাওয়াও যায় না, এখানে ১০০ টাকার মধ্যে খুব ভালভাবে সেরে নেয়া যায় খাবারটা।
ছাত্রদের মধ্যে অনেকে জানান যেহেতু আশেপাশে কোন হোটেল নেই, তাই তারা এখানেই খান এবং তাদের মতে খাবারটা ফ্রেশ এবং খারাপ লাগে না খেতে।
আর একদল মানুষ এখানে খেতে আসেন, যারা কর্মজীবী। তাদের সাথে কথা বলে বিভিন্ন মত জানা যায়। তাদের কারো কাছে খাবারের মান অত আহামরি কিছু নয়, ‘মোটামুটি’ হোটেলের মতোই মান- জানান গাড়িচালক মোঃ মীর হোসেন। তার কাছে দামটাও বেশি মনে হয়।
নর্থ-সাউথ এর ৩য় শ্রেনীর কর্মকর্তা জুয়েলের কাছে খাবারের স্বাদ জানতে চাইলে বলেন, ‘নরমাল এর স্বাদ নরমালই হইব। ’
দুই বিভাগের মানুষের সাথে কথা বলে বোঝা গেলো, ঘাটপাড়ে দুপুরে খেতে আসাটা ছাত্রদের কাছে রোমাঞ্চকর হলেও শ্রমজীবী-কর্মজীবীদের কাছে এটা তাদের জীবন কাঠামোর বাস্তবতা।
তাদের কাছে ৬০ টাকার মাংস, ৩০ টাকার খিচুড়ি, ১০ টাকার ভর্তাও একটু বেশিই দাম ঠেকে। যারা প্রতিদিন দুই বেলা ভাত-ডালে বেঁচে থাকেন, তাদের কাছে ঘাটপাড়ের আয়জোনটা ব্যতিক্রম নয়।
এতকিছুর পরও শ্রেণি ব্যবধান ভুলে গিয়ে দুই সমাজের মানুষ একজায়গায় বসেই খান।
মেয়েদের সংখ্যা কম হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরাও অনেকেই এখানে খেতে আসেন।
এ ব্যপারে কর্মচারী ইলিয়াসকে জিজ্ঞেস করলে বলেন, তার কাছে খুবই ভালো লাগে যখন মেয়েরা খেতে আসে, তাদের মত মানুষ এই দোকানে খেতে আসে ভেবে তার ভাল লাগে।
ঘটপাড়ের দোকানগুলোর নেই কোন মার্কেটিং কৌশল, কোন বিজ্ঞাপন বা ফেসবুক পেইজ। তবুও এই ছাপড়া হোটেল যা করতে পেরেছে তা বাকি তথাকথিত উন্নতমানের দোকানগুলো করতে পারেনি।
এইখানে ধনীর ছেলেরা এসে যেমন খেতে পারছে গরীবের পাশাপাশি বসে, ঐখানে গিয়ে একজন রিকসাচালকের খেতে বসার কথা অনেকটাই অকল্পনীয়।
তাহলে ঘাটপাড়ের কাস্টমারদের কি হাতছানি দিয়ে ডাকে? কম দাম, বাঙ্গালীর ভাত, নাকি মামা কালচারের আন্তরিকতা?
সামান্থা শাহরিন, শিক্ষার্থী, মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগ, আইইউবি, ঢাকা
বাংলাদেশ সময় ১০১৮ ঘণ্টা, মার্চ ২১, ২০১৬
এমএমকে