ফুলবাড়িয়া, ময়মনসিংহ থেকে: বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে ঘর ছেড়েছিলেন জীবন চন্দ্র দে। তখন বয়স ছিল মাত্র ১৫ কী ১৬ বছর।
শত্রুর গতিবিধির খবর সংগ্রহই শুধু নয়, অস্ত্র হাতে সম্মুখসমরেও লড়েন তিনি।
এমন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেই কাদেরিয়া বাহিনীর হয়ে নেমেছিলেন পাকিস্তানিদের হটানোর যুদ্ধে। শত্রুমুক্ত হওয়ার মাত্র মাসখানেক আগে নভেম্বরে ১১নং সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল হামিদুল্লাহ খান ও কোম্পানি কমান্ডার রফিজ উদ্দিন রেফাজের নির্দেশে জামালপুরের গুদারাঘাটে গিয়েছিলেন ডানপিটে এ ছেলেটি।
ওই সময় জেলার কামালপুরে ছিল পাকিস্তানি সেনাদের শক্ত ঘাঁটি। সেখানকার গুদারাঘাটে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানিদের সম্মুখযুদ্ধ চলাকালে তাদের ব্রাশফায়ারে কিশোর জীবন চন্দ্র সেদিন প্রাণে বেঁচে গেলেও চিরদিনের জন্য তাকে হারাতে হয় শরীরের মূল্যবান দু’টি অঙ্গ ডান হাত ও পা।
বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে ফিরেই হাসপাতালে হাসপাতালে যুদ্ধাহত ও পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের দেখতে গিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখা এ যুদ্ধাহত বীর যোদ্ধার সঙ্গেও ওই সময় মিনিট দুয়েক কথা বলেছিলেন জাতির জনক।
পরম মমতায় জীবন চন্দ্র দেকে বঙ্গবন্ধু টেনে নিয়েছিলেন বুকে। বলেছিলেন, ‘আমার ডাকে সাড়া দিয়ে যুদ্ধ করেছো। তুমি যা হারিয়েছো, সেই ক্ষতি পূরণ করার মতো ক্ষমতা আমার নেই’। জাতির জনক বলেছিলেন, ‘আমি তোমাদের জন্য মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট করে যাবো’।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সেই সাক্ষাৎপর্ব গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা জীবন চন্দ্র দে’র কাছে এখন শুধুই স্মৃতিময় দীর্ঘশ্বাস। মহান স্বাধীনতার স্থপতির সেই স্বান্তনা আজো তাকে আবেগাপ্লুত করে।
প্রিয় নেতার অসীম মানবিকবোধে জীবনের চোখের অশ্রু সেদিন বাঁধ মানেনি। আজো স্মৃতির পাতায় জ্বল জ্বল করে উঠতেই ছল ছল হয়ে ওঠে চোখজোড়া।
গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা জীবন চন্দ্র দে’র বাড়ি ময়মনসিংহ নগর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরের ফুলবাড়িয়া উপজেলায়। এখানকার পুঁটিজানা ইউনিয়নের অজপাড়া গাঁ দেবগ্রামের জীর্ণ মরচেপড়া একচালা টিনশেড ঘরই তার স্থায়ী ঠিকানা।
বুধবার (২৩ মার্চ) দুপুরে বাড়ির উঠোনে বসেই বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপ হয় তার। বয়সের ভারের পাশাপাশি অচল এ মানুষটির শরীরেও দিন দিন নানা রোগ বাসা বেঁধেছে।
স্থানীয় এক কিশোর বাংলানিউজকে নিয়ে যান মহান মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গণের অগ্নিপুরুষ জীবন চন্দ্র দে’র কাছে।
বাঁশের স্ক্র্যাচে করে ঘরের চিলেকোঠায় দাঁড়িয়ে ছিলেন এ মুক্তিযোদ্ধা। সাংবাদিক পরিচয় জানতে পেরেই অমায়িক হাসি দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে নেমে আসেন উঠোনে।
তেলে ভেজা চুল চকচক করছে। পাক ধরেছে দাঁড়িতেও। কুঁকড়ে গেছেন যুদ্ধাহত গেরিলা এ মুক্তিযোদ্ধা।
একাত্তরের যুদ্ধ দিনের খণ্ড খণ্ড স্মৃতি হাতড়াতে গিয়ে নিজেকে আর সামাল দিতে পারেননি বাংলা মায়ের এ সূর্য সন্তান।
বলতে থাকেন, ‘তখন আমি মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। ছাত্রলীগের পুঁটিজানা ইউনিয়নের প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছি। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের আহবানে সবাই আবেগ উদ্দীপ্ত হয়ে উঠি’।
‘স্কুলপড়ুয়া ১৫ থেকে ১৬ জন শিক্ষার্থী চিন্তা করলাম, এখানে সংগ্রাম পরিষদ গঠনের কথা। নিজেরা ঘরোয়া বৈঠকও করলাম। বৈঠক শেষে বের হয়ে পড়লাম কাদেরিয়া বাহিনীর সঙ্গে। টাঙ্গাইলের সখীপুরে আমাদের প্রশিক্ষণ শুরু হলো’।
এপ্রিলের শেষ প্রান্তে পাড়ি জমান ওপার বাংলায়। সেখানে লালপুর সেন্টারে আরো ১৫ দিনের প্রশিক্ষণ নেন জীবন চন্দ্র।
যুদ্ধদিনের ভয়াল স্মৃতি উচ্চারণ করতেই তেজোদীপ্ত হয়ে ওঠে কন্ঠস্বর। খানিক সময় থেমে এবার নিজের জীবনের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নৃশংসতার কথামালা উঠে আসে আবেগী উচ্চারণে-‘জামালপুরের কামালপুরে শত্রুসেনাদের শক্ত ঘাঁটি। কোম্পানি কমান্ডার নির্দেশ দিলেন, তাদের খতম করার। সেদিনের গেরিলা অপারেশনে পাকিস্তানি সেনাদের ব্রাশফায়ারে উড়ে যায় আমার এক হাত ও পা। কিন্তু আমরা ডুবিয়ে দিয়েছিলাম পাকিস্তানি সেনাদের দু’টি জাহাজ’।
জীবন চন্দ্ররা মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার খবরে ভয়াবহ নির্যাতন ও বর্বরতার শিকার হতে হয়েছিল তাদের দেবগ্রামের বাসিন্দাদের। বলতে থাকেন, ‘পাকিস্তানিরা এ এলাকাকে শ্মশানে পরিণত করেছিল। প্রায় শতাধিক ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছিল। অসংখ্য মা-বোনকে নির্যাতন করেছিল। ’
এসব কথা তুলে ধরতে গিয়েই কান্নারা যেন দলা পাকায় তার কন্ঠস্বরে।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের একটি ঝাপসা ছবি আজো জীবন চন্দ্রের কাছে মধুর স্মৃতি। ওই সময়কার একটি জাতীয় দৈনিকে ছাপা হয়েছিল সেই ছবি। একটি ফাইলে ওই ছবি, বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষরিত একটি চিঠি, স্বাধীনতা সংগ্রামের সনদপত্র রেখেছেন সযতনে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের পর শুরু হয় জীবন চন্দ্র দে’র জীবনের সংগ্রাম। স্ত্রী ও দু’সন্তানের ভরণ-পোষণের জন্য পাড়ার ছোট ছেলে-মেয়েদের প্রাইভেট পড়াতে শুরু করেন।
কিছুদিন আগে পড়ানোর কাজ ছেড়ে স্থানীয় একটি সেচ প্রকল্পে হিসাব-নিকাশ করার কাজ নিয়েছেন। সেখান থেকে মাসিক ২ থেকে ৩ হাজার টাকা পান।
এ কাজ থেকে উপার্জিত অর্থ ও মুক্তিযোদ্ধা সম্মানিভাতা বাবদ প্রাপ্ত ১০ হাজার টাকা দিয়েই নানা টানাপড়নের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তার জীবন। নিজের চাওয়া-পাওয়াকে খুব একটা গুরুত্ব দেন না।
এ কারণে নিজের দু’সন্তান রাধা রাণী দে ও জয় চন্দ্র দে’কে অভাব-অনটনের মধ্যেও শিক্ষিত করে তুলছেন। শুধু চান, পড়াশোনা শেষ হলে তাদের দু’জনের সরকারি চাকরির ব্যবস্থা করা।
লাল-সবুজের পতাকা পত পত করে ওড়াতে, স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রে বুকভরে নি:শ্বাস নিতে নিজের জীবন বিপন্ন করে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন জীবন চন্দ্র।
স্বাধীন দেশে মন্ত্রী হয়েছেন যুদ্ধাপরাধীরা। তাদের বিচারের কাজ চলছে। কিন্তু থেমে নেই যুদ্ধাপরাধীদের আস্ফালন- এ নিয়ে আত্মগ্লানিতে ভোগেন মুক্তিযোদ্ধা জীবন চন্দ্র।
বলেন, শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির মধ্যে দিয়ে নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছে। সব যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ হলেই গোটা জাতির মতো নিজেকে কলঙ্কমুক্ত মনে করবেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ০০৪৫ ঘণ্টা, মার্চ ২৪, ২০১৬
এএসআর