ভূরুঙ্গামারী (কুড়িগ্রাম) থেকে ফিরে:
'ও ধান ভানিরে
ঢেঁকিতে পাড় দিয়া।
ঢেঁকি নাচে আমি নাচি
হেলিয়া দুলিয়া।
জানি না এই গানের করিগর কে? কিন্তু এখন আর এই গান ধান ভানতে গাওয়া হয় না। এ গান এখন বন্দি রেডিও-টেলিভিশনের সংগ্রহশালায় অথবা ইউটিউবে। আবহমান গ্রাম বাংলায় ধান ভানার সংস্কৃতি না থাকলেও ঢেঁকির ব্যবহার কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি।
সম্প্রতি কুড়িগ্রাম জেলার ভূরুঙ্গামারী উপজেলার গ্রামের মেঠো পথ ধরে হাঁটার সময় কানে এসে লাগলো ঢেঁকির শব্দ। থমকে দাঁড়াতে হলো। আহা..! কত বছর থেকে ঢেঁকির শব্দ শোনা হয় না? তা কী বলতে পারবে শহরের এই অস্থির মস্তিষ্ক।
কৌতূহল নিয়ে সেই শব্দের উৎস খুঁজতে গিয়ে ভাসানী পাড়া গ্রামের দুই গৃহবধূকে ঢেঁকিতে গুঁড়ি কোটার সময় ক্যামেরাবন্দি করা সম্ভব হলো।
উপজেলার কালাচাঁন মোড়, দক্ষিণ ছাট গোপালপুর, মাদ্রাসা পাড়া, তিলাই মোড়, শোল ধুপরি, ভাসানী পাড়াসহ বেশ কিছু গ্রাম ঘুরে ঢেঁকি ব্যবহারের খবর পাওয়া গেলো।
এসব এলাকার গৃহস্থ বাড়িতে ঢেঁকি আছে বলে জানা যায়। তবে তা এখন ধান ভানতে ব্যবহার হয় না। রকমারি পিঠা বানাতে গুঁড়ি কোটার জন্য এসব ঢেঁকি ব্যবহৃত হয়। পাড়ায় যাদের বাড়িতে ঢেঁকি নেই, তারা ওই সব গৃহস্থ বাড়ি থেকে গুঁড়ি কুটে আনেন। এই গুঁড়ি কোটার মধ্যদিয়ে গ্রামে ধনী ও দরিদ্রদের মধ্যে চমৎকার সামাজিক বন্ধনও গড়ে উঠে।
এক সময় এই বঙ্গভূমিতে ধান ভানাই ছিল ঢেঁকির প্রধান কাজ। পাশাপাশি চিড়ে কোটা, গুঁড়ি কোটা, আটা ও ছাতু বানানোর কাজ করা হতো। এখন সব কিছু যন্ত্রনির্ভর হয়ে যাওয়ায় ঢেঁকির প্রতি তাই অবহেলা দিন দিন বেড়েই চলছে। তাই অদূর ভবিষ্যতে ঢেঁকির স্থায়ী ঠাঁই হতে যাচ্ছে জাদুঘর।
তখন নতুন প্রজন্মকে হয়তো ঢেঁকির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে এভাবে- ‘ঢেঁকি কাঠের তৈরি, বিভিন্ন গাছের কাঠ দিয়ে ঢেঁকি তৈরি করা যায়। মেহগুনি বা সেগুন গাছের কাঠের ঢেঁকি বেশি দিন টেকে। ’
ঢেঁকি তৈরির জন্য গাছ কেটে ৬ ফুট লম্বা এবং ৫-৬ ইঞ্চি পুরত্বের কাঠের খণ্ড আলাদা করতে হয়। মাথার দিকটা সুরু মোটা ও পায়ের দিকটা চ্যাপ্টা আকৃতির বানাতে হয়। মাথার দিকে দেড় থেকে দুই ফুটের শুঁড় সংযোজন করতে হয়। যাকে বলে মুষল, কেউ বলে চুরুন। মুষলের শেষ দিকে বসানো থাকে লোহার চাকতি। ঢেঁকি যেখানে বসানো হয়, সেখানে ঢেঁকির মাথার দিকে গর্ত খোঁড়া হয়। এই গর্তকে বলাহয় নোট, গর্তের মধ্যে পাথর বা কাঠ খোদাই করে বসানো হয়। ঢেঁকির পেছনের দিকটা থাকে একটি ফ্রেমে আটকানো, যাকে বলে কাতলা। কাতলা থেকে বর্ধিত অংশে পা দিয়ে চাপ দিলেই শুরু হয় ঢেঁকির নাচন।
ভাসানী পাড়ার গৃহস্থ ও সরকারি চাকরিজীবী মো. ইউনূস আলী। তার বাড়িতে রয়েছে একটি ঢেঁকি। তিনি জানান, বাড়িতে জামাই জোড়া কিংবা মেহমান আসলে শুধু গুঁড়ি কোটার কাজে ঢেঁকি ব্যবহার হয়। আগের মতো ঢেঁকির আর ব্যবহার নেই।
ঢেঁকি, নোট, কাতলা, মুষল বানানোর খরচ সর্ব সাকুল্যে খরচ হয় ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা। অবশ্য কাঠভেদে খরচ কম -বেশি হতে পারে বলেও জানান তিনি।
পাশের বাড়ি এক জাওয়ের (দেবরের বউ) সঙ্গে পিঠা বানানোর জন্য গুঁড়ি কোটায় ব্যস্ত ছিলেন ইউনূস আলীর স্ত্রী মোছা. সুফিয়া খাতুন।
তিনি বলেন, 'ঢেঁকি ছাটা চালের ভাত খাইতে খুব মজা। কিন্তু কে করে এই পরিশ্রম। ছেলেমেয়ারা বাড়িতে আইলে, আত্মীয়-স্বজন আইলে গুঁড়ি কোটার কাজটা খালি করি ঢেঁকিতে। ধান তো সব মেশিনেই ভাঙাইতে হয়। '
এ প্রজন্মের অনেকেই ঢেঁকি দেখেনি, শুনেনি ঢেঁকির শব্দও। গ্রামের পথে হাঁটার সময় আকস্মিকভাবে ঢেঁকির শব্দ ভেসে আসলে তাদের মধ্যে কী কোনো প্রতিক্রিয়া হবে? নাকি ফেসবুকের চ্যাটিং বক্সের শব্দের দাপটে ঢেঁকির শব্দ কেবলই বিরক্তিকর হয়ে ওঠবে…!
বাংলাদেশ সময়: ০৪১৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৪, ২০১৬
টিআই