করাচি, পাকিস্তান থেকে: ‘ উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। ’ তৎকালীন অখণ্ড পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলা ভাষাভাষীদের উপেক্ষা করে দম্ভের সঙ্গে এ কথা জানিয়েছিলেন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল ‘কায়েদে আযম’ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ।
যার প্রতিবাদে ভাষার জন্য প্রাণ দিতে হয়েছিলো বাঙালিকে। বাংলা ভাষার জন্য ঝরেছিল বুকের তাজা রক্ত।
অথচ সেই বাংলা ভাষার বিরুদ্ধাচরণকারী জিন্নাহ’র কবরেই টগবগ করছে বাঙালির প্রাণের ভাষা বাংলা। যা মাথা উঁচু করে জানান দিচ্ছে অদম্য বাংলার শ্রেষ্ঠত্ব।
বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিতে প্রধান এই আপত্তিকারী মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর কবরে বাংলা ভাষাতেই লেখা রয়েছে তার জন্ম ও মৃত্যু তারিখ।
ইতালিয়ান শ্বেত মার্বেলে তৈরি সমাধিতে উর্দুর পাশাপাশি লেখা এই বাংলা হরফ দু’দেশের ইতিহাস জানা যে কোন বাংলা ভাষাভাষীকে নিঃসন্দেহে গর্বিত করে তোলে। পাকিস্তানিরা অবশ্য এটাকে ‘অখণ্ডতার’ প্রমাণ হিসেবেই দেখে।
তবে শুধু মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’রই নয়, তারই ছোট বোন ফাতেমা জিন্নাহ, তার ডান হাত বা ‘কায়েদে মিল্লাত’ নামে পরিচিত পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিন, ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পর পাকিস্তানের যোগাযোগমন্ত্রী সরদার আবদুর রব নিশতার-এর কবরেও একইভাবে তাদের নাম, জন্ম ও মৃত্যুর তারিখগুলো বাংলা বর্ণমালায় খোদাই করে লেখা রয়েছে। এরা প্রত্যেকেই বাংলাকে তৎকালীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার তীব্র বিরোধী ছিলেন।
করাচিতে অবস্থিত পাকিস্তানের জনক ও দেশটির তৎকালীন গভর্ণর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র সমাধিস্থল বা মাজারে কায়েদ দেশটির অন্যতম একটি দর্শনীয় স্থান। সবার জন্য উন্মুক্ত এই সমাধিস্থলটি প্রতিদিন হাজার হাজার লোক পরিদর্শন করে। একজন আলেম তাদের নিয়ে ফাতেহা পাঠসহ মোনাজাত পরিচালনা করেন।
‘কায়েদে আজম’ এর মাজারে ২৪ ঘণ্টাই দেওয়া হয় গার্ড অব অনার। চারমাস পর পর দেশটির সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী পালাক্রমে সার্বক্ষণিকভাবে এ দায়িত্ব পালন করে।
জিন্নাহর সমাধিটি করাচি নগরীর মধ্যস্থলে প্রায় ৬১ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত। মাজার কমপ্লেক্স ঘুরে দেখানোর সময় পরিচালক জানালেন, স্মৃতিসৌধটি নির্মিত ৭৫ বাই ৭৫ মিটার প্লাটফরমের উপর। এর মূল স্তম্ভটির উচ্চতা ৪৩ মিটার। এই স্মৃতিসৌধ ঘিরে রয়েছে বিশাল একটি উদ্যান। সুউচ্চ প্রাসাদ কম থাকায় করাচির বিভিন্ন প্রান্ত থেকেই মাজারে কায়েদ’ এর সাদা রঙের স্মৃতি সৌধটি নজর কাড়ে।
পাক সরকারের নিমন্ত্রণে দেশটি সফরকালে তাদের পক্ষ থেকে এ সমাধিস্থল পরিদর্শনে নিয়ে যাওয়া হয়। যেখানে জিন্নাহ’র ব্যবহার্য সামগ্রী নিয়ে একটি জাদুঘরও রয়েছে। পোশাক, জুতা, আসবাবপত্র, গাড়ি থেকে শুরু করে তার ব্যবহার্য সকল জিনিসই প্রদর্শিত রয়েছে সেখানে। যা দেখে যে কেউ আন্দাজ করতে পারে তার পরিশ্রমী এবং সুরুচি সম্পন্ন জীবনযাপন নিয়ে।
তবে বিখ্যাত সেই জিন্নাহ টুপির দেখা মেলেনি এই জাদুঘরে। জানতে চাইলে জাদুঘর কর্তারা বলেন, সেটি পাকিস্তানের জাতীয় যাদুঘরসহ অন্যান্য কিছু স্থানে সংরক্ষিত রয়েছে।
এই সমাধিস্থলে বাংলা ভাষা লেখা নিয়ে দেশটির সরকারের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন,“মোহাম্মদ আলী জিন্নাহসহ অন্যান্যরা যখন মারা যান, তখন দুই দেশ (বাংলাদেশ ও পাকিস্তান) মিলে অখণ্ড পাকিস্তান ছিল। সে সময় পাকিস্তানে উর্দু এবং বাংলা দুটি ভাষা-ই প্রচলিত ছিল। উর্দু ভাষাভাষীদের পাশাপাশি বাংলা ভাষাভাষীদের জন্যই বাংলা অক্ষরে জিন্নাহসহ এসব নেতাদের নাম, জন্ম ও মৃত্যুর তারিখ লেখা হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও সেটি সেভাবেই রাখা হয়েছে। এটা আজও অতীতে দু’দেশের ‘অখণ্ডতার’ প্রমাণ দেয়। ”
এ সময় তিনি আরও বলেন, “বাংলাও ভীষণ মিষ্টি ভাষা। এ ভাষার জন্য শহীদ হওয়া প্রতিটি মানুষের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা রয়েছে। ”
পাকিস্তানের জাতির পিতা ‘কায়েদে আযম’ এর প্রতি দেশটির জনগণের রয়েছে অগাধ শ্রদ্ধা। দেশের বিভিন্ন অফিস-আদালত, হাসপাতাল, স্কুল কলেজ সবখানেই পাওয়া যাবে তার ছবি। মুসলিম দেশ হলেও এতে কোন কার্পণ্য রাখেনি পাকিস্তানিরা।
ব্রিটিশ ভারতের করাচিতে ১৮৭৬ সালের ২৫ ডিসেম্বর তৎকালীন বোম্বে প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত করাচির ওয়াজির ম্যানশনে জন্মগ্রহণ করেন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ। যা বর্তমানে পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের রাজধানী। শৈশবে তার নাম ছিল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ভাই।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, তার পরিবার শিয়া ইসমাইলি মতের অনুসারী ছিল।
দীর্ঘদিন রোগে ভোগার পর ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর করাচিতে নিজ বাসভবনে তার মৃত্যু হয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৬, ২০১৫
জেপি/আরআই