ঢাকা: গত পাঁচ দিনে তিন হাজার টাকা আয় করেছেন আব্দুুস সাত্তার। এখন বগুড়া ফিরছেন।
‘উনার নাম কি, মফিজ?’ জানতে চাইলে বললেন, ‘নাহ! আমরা ডাকি মফিজ কইয়ে!’
নিজেই নিজের এলাকার মানুষকে ‘মফিজ’ ডাকার বিষয়টি অদ্ভুত ঠেকলো। তাই কথা এগুলো।
জানা গেলো বগুড়ার কাহালুতে বাড়ি সাত্তারের। গত একমাসের বেশি সময় ঢাকায় আছেন । এখন ধান কাটার মওসুম। তাই বাড়ি যাচ্ছেন।
পূর্নিমা সিনেমা হলের সামনের আন্ডারপাসের পাশ ধরে তখন একটা বড় জটলা। কেউ বসে কেউ দাঁড়িয়ে। এরা সবাই ট্রাকের অপেক্ষায়।
উত্তরবঙ্গের এই খেটে খাওয়া মানুষগুলোর বাড়ি ফেরার বাহন হিসেবে ট্রাকই পছন্দ। জীবনের ঝুঁকি অনেক। তবে ভাড়া কম। তাই তারা দল বেঁধে অপেক্ষা করেন একটি খালি ট্রাকের আশায়।
ট্রাকগুলো মাল বোঝাই হয়ে আসে, ফিরে যায় খালি হয়ে। তারই সুবিধা নেন এই সাত্তাররা। তবে কেউ কেউ মাল বোঝাই ট্রাকেও চেপে বসেন।
একের পর এক ট্রাক আসছে। ‘৫০ টাকা বগুড়া, ৫০ টাকা বগুড়া’ বলে হাঁক দিচ্ছিলো ট্রাকের হেলপাররা। এর মধ্যেও কেউ কেউ ভাড়া নিয়ে দর কষাকষিও করেন। কিন্তু ঘণ্টা দুয়েক দাঁড়িয়ে কোন ট্রাকের হেলপারকেই ভাড়া কমাতে দেখা গেল না।
সাত্তারেরও তাড়া ছিলো। কিন্তু এরই মধ্যে আরও কিছু কথা হলো।
তার দুই ছেলে, এক মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে পাঁচ জনের সংসার। নিজের দুটি পা, দুটি হাতের শক্তিই একমাত্র উপার্জনের পথ। জানালেন ধান কাটার মওসুমে গ্রামে আয় ভালো হবে তাই ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছেন।
এরই মধ্যে এলো আরেকটি ট্রাক। ‘বগুড়া ৫০, বগুড়া ৫০’ হাঁক শুনে সাত্তার দ্রুত চেপে বসলেন তাতে। অনেকেই উঠে পড়েন তার মতো। কিন্তু তার পরেও থেকে যান কয়েকজন। কথা বলে জানা গেলো, তাদের ইচ্ছা, আরও ১০ টাকা কম ভাড়ায় মালবোঝাই ট্রাকের ছাদে উঠবেন।
তেমনই দুই জন জয়পুরহাটের ক্ষেতলালের নজরুল ইসলাম ও আব্দুস সবুর। জানালেন, এক সপ্তাহ রিকশা চালিয়ে কিছু সঞ্চয় করে বাড়ি ফিরছেন।
রিকশায় আয় কেমন? সে প্রশ্নে জানালেন, জমার খরচ বাদ দিয়ে প্রতিদিন একেক জনের আয় ছয় থেকে সাতশ’ টাকা। মগবাজার-বাংলামটর এলাকায় রিকশা চালান দু’জনই।
১০ টাকার জন্য ট্রাকের ছাদে উঠবেন! বেশি ঝুঁকি হয়ে গেলো না? এই প্রশ্নে সবুর জানালেন, এখান থেকে যারা বগুড়া যায় তাদের সুবিধা। কারণ ৫০ টাকা খরচে যেতে পারে। কিন্তু জয়পুরহাট যেতে তাদের বগুড়া থেকেই লেগে যায় আরও ৫০ টাকা। তাই অন্তত ১০ টাকা খরচ বাঁচানোর চেষ্টা।
কথা হলো সিরাজগঞ্জের আব্দুল মোমেনের সঙ্গেও। তিনি বাড়ি ফিরছেন ১ মাস ১০ দিন পর। রিকশাচালক মোমেনও ৪০ টাকার ভাড়ার ট্রাকের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। কারণ বগুড়ার ভাড়া দিয়েই তাকে যেতে হবে সিরাজগঞ্জ। তার চেয়ে দশ টাকা কম ভাড়ায় যাওয়া ভালো।
প্রতিটি ট্রাকের হেলপারই ভাড়ার সঙ্গে হাঁক দিয়ে বলছিলেন ‘খবরের কাগজ ফ্রি.. খবরের কাগজ ফ্রি’।
মোমেন জানালেন, এই খবরের কাগজ পড়ার জন্য না, ট্রাকের মেঝেতে পেতে বসে বা শুয়ে যাওয়ার জন্য।
রাত ২টা নাগাদ ভিড়টা একটু কমতে শুরু করলো। মানুষগুলো কেউ খোলা ট্রাকে, কেউ মাল বোঝাই ট্রাকের ছাদে বসে অন্ধকার রাতের যাত্রা শুরু করলেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই যাত্রা। ভোররাত নাগাদ সবাই পৌঁছে যাবেন গন্তব্যে।
বাংলাদেশ সময় ১০০৭ ঘণ্টা, মে ০১, ২০১৬
এমএন/এমএমকে