ঢাকা: বাঙালির প্রধান খাদ্য ভাত। সাধারণত রান্না করা ভাত বেঁচে গেলে তা সংরক্ষণের জন্য পানি দিয়ে রাখা হয় ও পরদিন সকালে সে ভাত পানিসহ বা পানি ঝরিয়ে খাওয়া হয়।
সংস্কৃতে পান্তাভাতকে ‘কাঞ্জিকা’ বলে। আবার ভারতের উড়িষ্যা ও ছত্তিশগড়ে পাখাল, পোখালো, পাখালা বা পাখাল ভাত নামে পরিচিত। বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উড়িষ্যা ও আসামে পান্তাভাত খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। পান্তাভাতের প্রচলন বহু আগেকার। ১৭ শতকের নথিতে পান্তাভাতের হদিস পাওয়া যায়।
জানা যায়, মুঘল আমলে সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সদস্যরা যখন মুক্তাঙ্গনে সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করতেন তখন দর্শকশ্রেতারা গান শুনতেন আর ঐতিহ্যবাহী খাবার খেতেন। এই খাবারের মধ্যে বিশেষ করে পান্তাভাত থাকতো।
প্রস্তুত প্রণালী
অঞ্চলভেদে পান্তাভাতের প্রস্তুত প্রণালী ভিন্ন। তবে ঐতিহ্যগতভাবে পাত্রে ঠাণ্ডা পানিতে বাসি ভাত ভিজিয়ে একটি পাতলার কাপড় দিয়ে পাত্রের মুখ ঢেকে ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টা রেখে দেওয়া হয়। আবার কোথাও কোথাও মাটির পাত্রে রান্না করা ভাত ও পানি দিয়ে তার মুখ পাতলা কাপড় দিয়ে ঢেকে সূর্যের আলো পড়ে এমন স্থানে রেখে দেওয়া হয়। প্রতিদিন এই পাত্রে এক মুঠ করে নতুন রান্না করা ভাত দেওয়া হয়। এভাবে তিন চারদিন রাখার পর তা খাওয়ার উপযোগী হয়। বেশি স্বাদ পেতে গাঁজন প্রক্রিয়ায় সরিষা, জিরা ও লাল মরিচ ব্যবহার করা হয়। আবার বিভিন্ন অঞ্চলে পান্তা পাতা পাত্রটি মাটিতে গর্ত খুঁড়ে মাটি চাপা দিয়ে কয়েকদিন রাখা হয়। পান্তাভাতকে উপরের তলার মানুষের কাছে আরও গ্রহণযোগ্য করতে আধুনিক সময়ে নানারকম রন্ধনশৈলী ব্যবহার করছেন রান্না বিশেষজ্ঞরা। ফ্রেশ রান্না করা ভাতে পানি দিয়ে তাতে আদা, কাঁচা আম বাটা, লেবু পাতা ও মরিচের ফোঁড়ন দেওয়া হয়। এরপর তা কাসুন্দি, সরিষা বাটা, পেঁয়াজ, ডাল, শুকনো তরকারি, ভাজা মাছ ও অম্বল দিয়ে খাওয়া হয়। এছাড়াও আধুনিক পান্তাভাতে ব্যবহার করা হয় চিনির সিরাপ ও গোলাপজল। এরপর এটিকে ছয় থেকে সাত ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখা হয়।
পরিবেশন ও আনুষঙ্গিক
পান্তাভাতের সঙ্গে চিরাচরিত আনুষঙ্গিক হিসেবে লবণ, মরিচ ও পেঁয়াজ খাওয়া হয়। এছাড়াও এর সঙ্গে ভাজা মাছ, সবজি, সরিষার তেল, আচার, শুটকি মাছ, মাছের ঝোল, সরষে ইলিশ, আলুভর্তা, বেগুনভর্তা ও অন্যান্য ভর্তা খাওয়া হয়। আসামে দুধ-পান্তা পাতা হয়। এতে দুধে ভাত ভিজিয়ে রাখা হয়। কখনও চিড়া, কলা, গুড়, দই ও লেবুর পাতা কুচি দিয়ে পরিবেশন করা হয় পান্তাভাত।
দক্ষিণ ভারতে লবণ-মরিচসহ পান্তাভাত অন্যতম প্রিয় মর্নিং বেভারেজ। আনুষঙ্গিক হিসেবে শুকনো তরকারি, ভাজা মাছ ও শুকনো ডাল খাওয়া হয়। টক উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয় কাঁচা আম, লেবু ও তেঁতুল।
পুষ্টিগুণ
পান্তাভাত রাইস বেসড একটি খাবার। ফ্রেশ ভাতের চেয়ে মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট সমৃদ্ধ পান্তাভাতের পুষ্টিগুণ অনেক বেশি। কুলিং ইফেক্ট থাকায় গ্রীষ্মকালে এটি উপাদেয় একটি খাবার। সামন্য গাঁজন প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় বলে এটি পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ। ১২ ঘণ্টা ধরে ভিজিয়ে রাখা একশো গ্রাম পান্তাভাতে রয়েছে ৭৩.৯১ মিলিগ্রাম লোহা যেখানে একই পরিমাপের ফ্রেশ ভাতে থাকে মাত্র ৩.৪ মিলিগ্রাম। একশো গ্রাম পান্তাভাতে রয়েছে ৩০৩ মিলিগ্রাম সোডিয়াম, ৮৩৯ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম ও ৮৫০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম যেখানে ফ্রেশ ভাতে থাকে মাত্র ২১ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম। গাঁজন প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় বলে পান্তাভাতে খুব অল্প পরিমাণে অ্যালকোহল থাকে। পান্তাভাতে আরও রয়েছে জিংক, রিবোফ্লাভিন ও ভিটামিন বি। আয়ুর্বেদে পান্তাভাত ঠাণ্ডা খাবার হিসেবে বিবেচিত, শিশুদের জ্বর হলে এটি খাওয়ানোর পরামর্শ দেন আয়ুর্বেদ বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ সময়: ০২৪২ ঘণ্টা, মে ২২, ২০১৬
এসএমএন/এসএনএস