ঢাকা: ‘আমি এই কবুতর তিন বছরে চারবার বিক্রি করছি। যতবারই বিক্রি করমু ওই ছাড়া পাইলেই আয়া পরবো আমার কাছে।
কবুতরটি হাতে নিয়ে তিনি বলেন, ‘গত বছর টঙ্গী গিয়া কবুতরটা বিক্রি কইরা আইছিলাম, জানেন মাত্র এক সপ্তাহের মাথায় আবার ফিরা আইছে আমার বাড়ির ছাদে। আইজ নয় জোড়া কবুতর নিয়া আইছিলাম, সব বিক্রি হইয়া গেছে। ওরে ছাড়ি নাই এখনও, আইজকা আর ছাড়ুম না, ক্যামন জানি মায়া-মায়া লাগতাছে। ’
কবুতর পোষার শুরুর গল্প জিজ্ঞেস করতেই হর-হর করে শাকিল বলেন, ‘আমার ছোট মামা নাম রতন আলী। তখন আমি অনেক ছোট, মামার বাসার ছাদে অনেক কবুতর পালতো। আমি ছোট বেলায় মামাবাড়ি যাওয়ার জন্য পাগল আছিলাম কবুতরের জন্য। তখন থিকায়াই কবুতরের প্রতি টান কাজ করে। ’
রতন মামা কিংবা ভাগ্নে শাকিলের মতো মানুষের শখের শেষ নেই। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এমন অনেক সৌখিন মানুষ রয়েছেন, যাদের শখ কবুতর পোষা। আর এ পোষা পাখিটি নিয়ে তাদের উন্মাদনার শেষ নেই। প্রাচীনকাল থেকেই এ দেশের বিভিন্ন স্থানে কবুতর উড়ানোর প্রতিযোগিতা হতো, যা আজও প্রচলিত আছে রাজধানীর পুরান ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায়।
পুরান ঢাকার বিভিন্ন বাড়ির ছাদে কবুতর পালন করা রীতিমত একটি ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। এই ঐতিহ্যকে ধারণ করে প্রতিবছরই বিভিন্ন এলাকায় কবুতর উড়ানোর প্রতিযোগিতা হয়। স্থানীয়রা একে বলে কবুতরের রেস। প্রত্যেক প্রতিযোগী নির্দিষ্ট সংখ্যক কবুতর নিজ বাড়ি থেকে প্রায় ৩০-৪০ কিলোমিটার দূরে গিয়ে একসঙ্গে ছেড়ে দেন। যার সবচেয়ে বেশি কবুতর বাড়ি ফিরে আসে তিনি বিজয়ী হন। প্রতিবছর এ রকম ৫-৬টা প্রতিযোগিতা হয় পুরান ঢাকায়। অনেক টাকা বাজিও হয় এই খেলায়।
রাজধানীর কাপ্তানবাজার কমপ্লেক্সের ছাদ। প্রতি শুক্রবার সাপ্তাহিক কবুতরের হাট বসে এই ছাদে। যেখানে বাহারি রংয়ের ও আকৃতির কবুতর বেচাকেনা হয়।
কবুতর ব্যবসায়ী কলিম শেখ জানান, এখানে ঢাকার ভেতর থেকে সবচেয়ে বেশি কবুতর আসে পুরান ঢাকা থেকে। ঢাকার বাইরে পাবনা, ফরিদপুর, নওগাঁ, গাজীপুর ও কুমিল্লা থেকে বেশি কবুতর আসে। সারাদেশের সৌখিন কবুতরপ্রেমীরা সবচেয়ে বেশি আশে এই বাজারে। আবার এখান থেকে কবুতর চলে যায় দেশের নানা জায়গায়।
কবুতরের দাম সম্পর্কে আরেক পাইকারি ব্যবসায়ী মোমিন জানান, যারা শখের বশে কবুতর পালন করে তারা দামের দিকে খেয়াল করে না। পছন্দ হলেই কিনে নিয়ে যায়। প্রত্যেক কবুতরের রয়েছে রঙ আর জাতভেদে দামের পার্থক্য। সিরাজি লাল জাতের কবুতর জোড়া প্রতি দাম ৬ হাজার, সিরাজি কালো ৪ হাজার ৫০০, সিরাজি হলুদ ৫ হাজার ৫০০, সিরাজি সিলভার ৮ হাজার টাকা।
কিং কবুতরের মধ্যে লাল ও সাদা কিং জোড়া প্রতি ৭ হাজার, হলুদ কিং ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা। ফিলব্যাক কবুতরে রয়েছে তিনটি প্রজাতি। সাদা ফিলব্যাকের জোড়া প্রতি দাম ২০ হাজার টাকা, কালো ৮ হাজার, হলুদ ফিলব্যাক ৩৫ হাজার টাকা। ভুটান নামেও রয়েছে কবুতর। হলুদ ভুটান কবুতরের দাম ৫ হাজার, কালো ৪ হাজার এবং লাল টান কবুতর ৫ হাজার ৫০০ টাকা জোড়া।
কবুতরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দাম হলুদ মুখীর। যার জোড়া প্রতি দাম ৭০ টাকা হাজার পর্যন্ত। এছাড়া অন্যান্য কবুতরের মধ্যে কালো নান ৬ হাজার, হলুদ ২০ হাজার, হলুদ রেন ৮ হাজার, বোখারা সাদা ১৫ হাজার, কালো ৭ হাজার, স্ট্রেচার লাল ৮-১০ হাজার টাকা জোড়া।
নারায়ণগঞ্জের কবুতর ব্যবসায়ী সজীব তালুকদার বলেন, সব ধরনের কবুতর এখানে ওঠে। ৫০০ টাকার থেকে লাখ টাকা কবুতরও এখানে আছে। ঢাকার আশপাশের জেলার লোকজনও এখানে কবুতর কিনতে আসেন। কিং, সিরাজি, পোর্টার, রেসার, বোখারি, জ্যাকোবিন, আমেরিকান হেলমেট, বিউটি হোমার, র্যাং, স্যালো, ট্রেম লাইট, পারভিন, গিরিবাজ, লাক্ষা এসব জাতের কদর বেশি।
কথা হলো কাপ্তানবাজার হাটে কবুতর কিনতে আসা একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া যাত্রাবাড়ীর সেজানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমি ৭ বছর বয়স থেকে কবুতর পালন করি। আমার বাসার ছাদে ওয়াইট রেসার, সাটিং, চক পাই, গররা, দোপাজ, ইরানি, বাঘা, মিলি, রিজেল, গিরিবাজ, সিরাজি, ফিলব্যাকসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় ৪২টি কবুতর রয়েছে।
সেজান বলেন, এখানে আসি কবুতর কিনতে, আবার কখনও নতুন-নতুন প্রজাতির কবুতর দেখতে। এছাড়া কবুতরের বিভিন্ন সামগ্রী কিনতে প্রতি সপ্তাহেই আমার কাপ্তান বাজারে আসতে হয়।
কবুতর কি শুধু শখের বশেই পোষা হয়? এমন প্রশ্নের জবাবে সেজান জানান, না প্রথম-প্রথম শখের বশে পোষা শুরু করলেও এখন প্রতিমাসে এই কবুতর থেকেই আমার ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা আয় হয়। কবুতর বাচ্চা দিলে এগুলোকে একটু বড় করেই বাজারে ভালোই দাম পাওয়া যায়। কখনও কখনও একটু বয়স হয়ে গেছে এমন কবুতরগুলোকে বাচ্চা রেখে বিক্রি করে দিই। এছাড়া কবুতরের বিভিন্ন প্রতিযোগিতা থেকেও মাঝে-মাঝে কিছু উপরি আয় হয়।
এই হাটে কবুতর ছাড়াও কবুতরের খাবার, ওষুধ, খাঁচা ইত্যাদি জিনিসও পাওয়া যায়। সোহাগ কাপ্তানবাজারের এই হাটে ৫ বছর ধরে বিক্রি করেন খাবারের উপকরণ। তিনি জানান, খাবারের ভিতরে ধান, গম, চিনা, ভুট্টা, রেজার প্যাকেট ১০ টাকা থেকে ৪০ টাকায় পাওয়া যায়। তাছাড়া তার দোকানে আরও আছে ট্যাগ, ইনজেকশন ব্যাগ, খাবার রাখার পট, প্লাস্টিকের ডিম, গ্রিচ (ইটের গুড়া, শামুক, ডিমে খোসা দিয়ে তৈরি খাবার)। আর পাইকারি এসব খাবার সংগ্রহ করতে চাইলে বঙ্গবাজার তো আছেই।
বাংলাদেশ সময়: ২০০৮ ঘণ্টা, মে ২২, ২০১৬
টিআই