ঢাকা, শনিবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

খাই চিকেন ফ্রাই, তবে মুরগির নয়!

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ২, ২০১৭
খাই চিকেন ফ্রাই, তবে মুরগির নয়! ল্যাবরেটরিতে তৈরি চিকেন’র ফ্রাই

স্বাদ পরীক্ষকরা খাবারটি মুখে তুলেই বললেন, বাহ! বেশতো! বেশ মজা। স্বাভাবিকের চেয়ে কেবল সামান্য স্পঞ্জি। আর গোটাটা খেয়ে সবাই বললেন, আবার খাবো!

একজনতো খুশিমুখে বললেন, পুরোইতো মুরগির মাংস।  
অপরজন বললেন, আমিতো বুঝতেই পারিনি।

 

তবে এই পরীক্ষক দল যে মুরগি খাচ্ছিলেন তা কিন্তু মুরগি নয়। মুরগির স্বাদ বটে কিন্তু সে মুরগি কখনো এই পৃথিবীর বুকে হেঁটে বেড়ায়নি, শ্বাস নেয়নি পৃথিবীর বাতাসে, কক-কক ডাকেওনি কোনও কালে। আর জবাই হয়ে তবে এই খাদ্যে পরিণত হয়েছে এমনটাও নয়।  

তাহলে এই মুরগি এলো কোত্থেকে? বলতে পারেন ল্যাবরেটরিতে উৎপাদিত মুরগির মাংস। উৎপাদকরা নাম দিয়েছে সেসুলার এগ্রিকালচার পদ্ধতি। যার মাধ্যমে তৈরি হচ্ছে মুরগি কিংবা হাঁসের মাংস।  

সিলিকন ভ্যালি শুনলেই প্রযুক্তির উৎপাদনক্ষেত্রে বলে কে না বুঝবে। আর সেই সিলিকন ভ্যালিতেই এই মুরগির মাংসের উৎপাদক মেম্ফিস মিটস নামের একটি প্রতিষ্ঠান।

গেলো সপ্তাহে উৎপাদন সাফল্যের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে মাংস শিল্পে এক মাইলফলক রচনার কৃতিত্ব দাবি করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

আর সকলে এই অগ্রগতিকে এক ঐতিহাসিক ব্রেকথ্রু বলেই তকমা দিচ্ছেন।  

আন্দোলনটির নাম ‘ক্লিন মিট মুভমেন্ট’। এক্বেবারে যে নতুন কিছু, তা কিন্তু নয়। এর আগে ল্যাবরেটরিতে গরুর মাংস উৎপাদন হয়ে গেছে। সে কৃতিত্বের দাবিদার লন্ডন। সেখানে ল্যাবে তৈরি গরুর মাংসে প্রথম হ্যামবার্গারটি তৈরি হয়েছে সেই ২০১৩ সালে। তার প্রায় সাড়ে তিন বছর পর গেলো নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা দিলো তারা ল্যাবে তৈরি টার্কির মাংসে নাগেট বানিয়েছে। যা চেখে দেখে স্রেফ টার্কি বলেই মত দিয়েছেন স্বাদ গ্রহণকারীরা। মুরগিটাই ছিলো বাকি। তা এবার হয়ে গেলো। ল্যাবে তৈরি ক্লিন মিটের জগতে তালিকাভুক্ত হলো মুরগির মাংসেরও নাম।  

মেম্ফিস মিট বলছে, আর নয় মুরগি কিংবা হাঁসের গলাকাটা। স্রেফ ল্যাবরেটরিতেই তৈরি হচ্ছে এমন স্বাদের মাংস। স্বাদ নিয়ে সে পরীক্ষাও এখন শেষ। এখন শুধুই খাওয়া আর খাওয়া।

মেম্ফিস মিটের যুগ্ন-প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও উমা ভেলেটি বললেন, ‘এ এক ঐতিহাসিক ক্ষণ। মানবতার স্বার্থে প্রযুক্তির এক অসাধারণ আবিষ্কার। আর ব্যবসার ক্ষেত্রে এক অবিশ্বাস্য সুযোগ। টিকে থাকার যে অবিরাম সংগ্রাম, তার পথে বড় ভূমিকা রাখবে এই আবিষ্কার।

সারা বিশ্বেই মুরগির মাংস জনপ্রিয়। আর সবচেয়ে বেশিই খাওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রের হিসাবটা এমন গরু ও শুকর মিলিয়ে যত মাংস ভোগ করা হয় তার সমান পরিমান খাওয়া হয় মুরগি। আর গোটা বিশ্বে বছরে ৬ হাজার কোটি মুরগী জবাই হয়ে খাবার প্লেটে প্লেটে ছড়িয়ে পড়ে।

হাঁস প্রধানত চীনাদের সবচেয়ে পছন্দের। ওই এক দেশেই বছরে হাঁস জবাই হয় ১৩০ কোটি। বছরে ২৭ লাখ মেট্রিক টন হাঁসের মাংস খায় দেশটির মানুষ।

কেবল তাই নয় বিশ্বের দেশে দেশে খাবার টেবিলের মাঝ বরাবর মুরগি ও হাঁসের মাংসের বাটি শোভা পায়, আর সবার আগেই শেষ হয়ে যায় ওই বাটির খাবার। এই বিশাল চাহিদা পূরণে হাঁস আর মুরগীর উৎপাদনে যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

পরিবেশ চিন্তকরাতো বড়ই চিন্তিত। আর সেগুলো ধীরে ধীরে মানব স্বাস্থ্যের জন্য যে ক্ষতিকর হয়ে উঠছে সে কথাও বলা হচ্ছে বারবার। সেখানেই ভূমিকা রাখবে এই কৃত্রিম উপায়ে তৈরি হাঁস ও মুরগির মাংস, শোনালেন উমা ভেলেটি। বললেন, আমরা অপেক্ষাকৃত উত্তম উপায়ে মাংস উৎপাদন করছি, তা স্বাদেও যেমন মুখরোচক তেমনি তা মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে। আর এটি হবে টেকসই এক অগ্রগতি।  

ভেলেটির মতো আরও অনেকেই মনে করেন, ল্যাবরেটরিতে তৈরি এই কৃত্রিম মাংসে মানুষের আগ্রহ বাড়লে তা খাদ্য নিরাপত্তা যেমন বাড়াবে, তেমনি পরিবেশ থাকবে অনেক বেশি সবুজ ও স্বাস্থ্যকর।

প্রচলিত পদ্ধতিতে মাংস উৎপাদন নিয়ে এরই মধ্যে নানা প্রশ্ন উঠেছে। যার অন্যতম দিকটি পরিবেশগত। পশু ও হাঁস-মুরগি পালনের মধ্য দিয়েই এই মাংস আসে। আর এসব প্রাণি বধের বিরুদ্ধেও রয়েছে এক ধরনের প্রতিবাদ, যা ধীরে ধীরে বিশ্বে জোরালো হচ্ছে বৈকি। এর বাইরে রয়েছে এসব পালন প্রক্রিয়ায় অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার প্রসঙ্গ। কিন্তু এই নতুন পদ্ধতির মাংস উৎপাদনে এর কোনও সমস্যাতো থাকছেই না, বরং তা প্রচলিত মাংসের চেয়ে স্বাস্থ্যকরও বটে।  

ল্যাবরেটরিতে বেড়ে ওঠা মাংস নির্দিষ্ট পরিমান পুষ্টিসম্মৃদ্ধও। আর ক্ষতিকর উপাদানমুক্ত। যেমন হেমি আয়রন, যা প্রচলিত পদ্ধতিতে উৎপাদিত গরু ও শুকরের মাংসে থাকার ঝুঁকি বেশি, আর যাতে ক্যান্সারের ঝুঁকিও রয়েছে, এই মাংসে নেই। আর অতি ক্ষতিকর স্যাচুরেটেড ফ্যাটমুক্ত এই মাংস।

এর বাইরে আছে জলবায়ু পরিবর্তন ও জনসংখ্যাধিক্যের প্রসঙ্গ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্লিন মিটে এই দুই প্রধান সঙ্কটের একটা সমাধান রয়েছে। গবাদি পশু এখন ১৫ থেকে ২০ শতাংশ গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃস্বরণের জন্য দায়ী। আর সে পরিমান দিন দিন আরও বাড়ছে। এই পথে গরুর মাংসই সবচেয়ে এগিয়ে।  

গরু যে বায়ুত্যাগ করে আর ঢেঁকুর তোলে তাতে রয়েছে মিথেইন- যা এক অন্যতম গ্রিন হাউজ গ্যাস আর কার্বন ডাইঅক্সাইডের চেয়েও বাতাসে বেশি গরম ছড়ায়।  

মুরগি ও শুকরের বিষ্ঠা থেকেও তৈরি হয় মিথেইন। পরিমানে কম হলেও সব মিলিয়ে গবাদি পশুই পৃথিবীকে মিথেইন গ্যাসে ভরে তোলার সবচেয়ে বড় উৎস যা মোট পরিমানের ৩৫ শতাংশ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)’র মতে ২০০১ সালের তুলনায় ২০১১ সালে এই গবাদি থেকে এই গ্যাস উৎপাদনের পরিমান ১১ শতাংশ বেড়েছে।

বিজ্ঞানীরা যখন বিশ্ব উষ্ণায়ন এই শতাব্দীর মধ্যে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমিয়ে আনার ওপর জোর দিচ্ছেন, তখন প্রচলিত পদ্ধতিতে মাংস উৎপাদন থেকে এই কৃত্রিম পদ্ধতির দিকে ঝুঁকতে পারলে তা সহায়ক হবে বৈকি। গরুর মাংস উৎপাদন কমিয়ে আনলে গরু থেকে মিথেইনও উৎপাদিত হবে না।  

বিষয়টি এখনো ব্যাপক গবেষণার দাবি রাখে, তবে প্রাথমিক তথ্য-উপাত্ত বেশ আশা জাগানিয়া। মেম্ফিস মিটস’র ভেলেটি সে কথাই বলছিলেন। তিনি বলেন, এই পদ্ধতিতে মাংস উৎপাদক কার্বন নিঃস্বরণ অর্ধেকে নামিয়ে আনবে।  

২০১১ সালের একটি গবেষণাতো আরও জোরদার তথ্য দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে প্রচলিত মাংস উৎপাদনের চেয়ে এই ক্লিন মিট গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃস্বরণ ৯৬ শতাংশ কমিয়ে দেয়। ভূমির ব্যবহার কমে যায় ৯৯ শতাংশ আর পানির ব্যবহার কমে ৯৬ শতাংশ।

এফএও’র হিসেবে ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের জনসংখ্যা বেড়ে ৯৬০ কোটিতে দাঁড়াবে। আর বিশ্বে মাংস খাওয়া বেড়ে যাবে আরও ৭৩ শতাংশ। খাদ্য নিরাপত্তার দিক থেকে চিন্তা করলে আমরা এরই মধ্যে আমাদের মোট চাষযোগ্য জমির ৭০ শতাংশ গবাদি প্রজনন প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করে ফেলেছি। সুতরাং এখন হয় আমাদের সবাইকে ভেজেটারিয়ান হয়ে যেতে হবে, নয়তো কম মাংসে অভ্যস্ত হতে হবে। কিন্তু আমরা যদি মানুষের খাদ্যাভ্যাসে এই পরিবর্তন না আনতে চাই, তাহলে এই ক্লিন মিটই হবে সবচেয়ে বড় সমাধান।  

চিকেন ফ্রাই খাবেন বটে, তবে তা আদৌ মুরগির হবে না।  

বাংলাদেশ সময় ১৬০২ ঘণ্টা, এপ্রিল ০২, ২০১৭
এমএমকে 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।