ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

পর্ব ১৪

ষড়যন্ত্রের গ্রিনরুম ছিল কাসিম বাজার

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৩২ ঘণ্টা, এপ্রিল ২১, ২০১৭
ষড়যন্ত্রের গ্রিনরুম ছিল কাসিম বাজার ষড়যন্ত্রের গ্রিনরুম ছিল কাসিম বাজার

মুর্শিদাবাদ ঘুরে: সতেরো শতকে ভাগীরথীর তীরে গড়ে উঠেছিল বাংলার সবচেয়ে বড় বাণিজ্যকেন্দ্র কাসিম বাজার। মুর্শিদাবাদ রেশম ব্যবসার জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। সে সময়ে রেশমের চাহিদা ছিল বিশ্বব্যাপী আর কাসিম বাজার ছিল ভারত বর্ষের প্রধান রেশম ব্যবসা কেন্দ্র। 

কাসিম বাজার শুধু বাংলার প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্রই ছিল না, বাংলার সঙ্গে ভারতবর্ষের যোগাযোগের অন্যতম প্রধান সংযোগস্থল ছিল এই কাসিম বাজার। ঢাকার সঙ্গে পাটনা, রাজমহল, ভাগলপুর ও মালদাসহ পুরো ভারতের সংযোগস্থল এই কাসিম বাজার।

জেমস রেনেল তার ‘দ্য ডেসক্রিপশন অব দ্য রোডস ইন বেঙ্গল অ্যান্ড বিহার’ (১৭৭৯) বইয়ে যোগাযোগের ক্ষেত্রে কাসিম বাজারের  গুরুত্ব তুলে ধরেন।  কাসিম বাজার জংশনএসব গুরুত্বের জন্য সেসময় ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা কাসিম বাজারে আসতেন। কাসিম বাজারে প্রথম বাণিজ্যিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে ওলন্দাজরা, এরপর ইউরোপীয়রা। এভাবে কাসিম বাজার প্রায় দেড়শ’ বছর বাণিজ্যিক গুরুত্ব বজায় রাখতে পেরেছিল।  

সুবেহ-বাংলার বা মুঘল ও ব্রিটিশ ভারতের সেই কাসিম বাজার এখন ইতিহাস। তবে সেই স্মৃতি বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি ব্রিটিশ, ডাচ-ওলন্দাজ সমাধিক্ষেত্র। তবে ধ্বংসোন্মুখ।  

কিন্তু সব কিছু ছাড়িয়ে কাসিম বাজার বাংলার ইতিহাসে আজ ষড়যন্ত্রের আখড়া হিসেবেই পরিচিত। বাংলাকে পরাধীন করে এখানকার মসনদে ইংরেজদের পদাবনত মীরজাফরকে বসানোর ষড়যন্ত্র হয় ব্রিটিশদের এই কাসিম বাজার কুঠিতেই। মুর্শিদাবাদ থেকে কাসিম বাজারের দূরত্ব প্রায় ১০ কিলোমিটার। এ ষড়যন্ত্রে সেদিন শামিল হয়েছিল মীর জাফর, রাজবল্লভ, রায় দুর্ভল, জগৎশেঠ, ইংরেজ ওয়াটস ও অন্যান্যরা।  ইংরেজদের সেই কুঠি অনেক আগেই ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু ষড়যন্ত্রের ইতিহাস এখনও মুছে যায়নি। বাংলার স্বাধীনতা ও পরাধীনতার ইতিহাস যতো দিন রবে, ততোদিন তাতে লেখা থাকবে কাসিম বাজার ষড়যন্ত্রের কথা।  

সিরাজ সেই ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরেছিলেন। তিনি তখন কলকাতা আক্রমণ নিয়ে পরিকল্পনা করছেন। এরই মধ্যে জানতে পারেন যে তারই বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে আর তাতে উপস্থিত আছেন তারই সভাপদ রাজবল্লভ-জগৎশেঠ চক্র।  

সিরাজ সিংহাসনে আরোহনের একমাস পর ১৬ মে শওকত জঙ্গকে পদানত করার জন্য পুর্ণিয়া যাত্রা করেন। ২০ মে তিনি রাজমহলে পৌঁছান এবং সেখানে তিনি সংবাদ পান যে তার প্রেরিত দূত নারায়ণ সিংকে ইংরেজরা অপমান করে তাড়িয়ে দেয়। নবাব এই সংবাদে ক্রুদ্ধ হন ও শওকত জঙ্গকে দমন করার কাজ বাদ দিয়ে ইংরেজদের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার জন্য সেনাবাহিনীকে মুর্শিদাবাদে প্রত্যাবর্তনের আদেশ দেন। এরইমধ্যে শওকত জঙ্গও সিরাজের কাছে বশ্যতা স্বীকার করেন।  কাসিম বাজার ছোট রাজবাড়ি

সিরাজ ইংরেজদের একটি সমুচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য কাসিম বাজার কুঠি আক্রমণ করেন। নবাব তার সামরিক বিভাগের দু’জন উচ্চপদস্থ কর্মচারী দুর্লভরাম ও হুকুম বেগকে কাসিম বাজারে পাঠান। ২৪ মে নবাবের ৩শ’ সৈন্য কাসিম বাজারে উপস্থিত হয় ও কাসিম বাজার অবরোধ করে। ২৫ মে আরও ২শ’ সৈন্য যোগ হয় এবং ৩ জুন সৈন্য সংখ্যা দাঁড়ায় ৩০ হাজার। এরপর নবাব নিজেই কাসিম বাজার উপস্থিত হন। কাসিম বাজার কুঠি থেকে ইংরেজদের পাকড়াও করে মুর্শিদাবাদে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কাসিম বাজার কুঠি বন্ধ করে দেওয়া হয়।  

কিছু দিন পরই (১০ জুনের আগেই) ইংরেজদের মুক্তি দেওয়া হয়। কিন্তু লেফটেনেন্ট ইলিয়ট ওয়াটস্ শান্তিনীতির বিরোধী ছিলেন বলে তিনি এসময় আত্মহত্যা করেন।  

কাসিম বাজার কুঠির অধ্যক্ষ উইলিয়াম ও সহ-অধ্যক্ষ ম্যাথিউ কোলেটকে সঙ্গে নিয়েই ৫ জুন নবাব কলকাতা অভিমুখে যাত্রা করেন। সিরাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্ষমতার ঘাঁটি এই কাসিম বাজার দখল করেন সত্য, কিন্তু ততোক্ষণে ষড়যন্ত্রের বোঝাপড়াটিতো হয়েই গিয়েছিল। এর ওপর বড় ধাক্কাটা লাগে ষড়যন্ত্রকারীদের নবাব গ্রেফতার করেও ছেড়ে দেন বলে। ফলে, ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করার পথে আর কোনো বাধাই রইলো না। পলাশীতে সেই ষড়যন্ত্রেরই বাস্তবায়ন হলো। ২শ’ বছরের পরাধীন বাংলা কাসিম বাজার ষড়যন্ত্র আর মীর জাফরের বিশ্বাস ঘাতকতার এক করুণ পরিণতিই বৈকি! 

বাংলাদেশ সময়: ১৩২১ ঘণ্টা, এপ্রিল ২১, ২০১৭
এইচএ/

আরও পড়ুন
** ১ম পর্ব: এক যে ছিলো মুর্শিদাবাদ

** ২য় পর্ব: কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদ
** ৩য় পর্ব: মানুষ যে হায় ভুলে গেছে চির মধুর ভালোবাসা
** ৪র্থ পর্ব: চার ভাইয়ের বাগান বিলাস ও একটি গুপ্তপথ
** ৫ম পর্ব: জগৎশেঠকে সপরিবারে হত্যা করা হয় যে প্রাসাদে
** ৬ষ্ঠ পর্ব: নুরলদীনের ‘জাগো বাহে’ শোনা যায় নসীপুর প্রাসাদে
** ৭ম পর্ব: কিরীটেশ্বরী মন্দির ও জগদ্বন্ধু সুন্দরের আশ্রম
** ৮ম পর্ব: মুর্শিদকুলি খাঁর কলিজাখেকো মেয়ের সমাধি!
** ৯ম পর্ব: হেস্টিংসের স্ত্রী, মেয়ের সমাধি ও একটি আর্মেনিয়ান চার্চ
** ১০ম পর্ব: মুজিবনগর ও পলাশী: বাংলার ইতিহাসের দুই আম্রকানন 

** ১১তম পর্ব: ৩শ বছরের ডাচ সিমেট্রি ও যোগেন্দ্র নারায়ণের মন্দির
** ১২তম পর্ব: সতীদাহ ঘাটের পাতালেশ্বর মন্দির

** ১৩তম পর্ব : আশি টাকার গাড়ি ও সোনার রথ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।