ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

কে এই ক্লাইভ?

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০১৯ ঘণ্টা, জুন ২২, ২০১৭
কে এই ক্লাইভ? সেনা ছাউনিতে ক্লাইভ

২৩ জুন ১৭৫৭ সাল। কয়েক ঘণ্টার ‘তথাকথিত-যুদ্ধ’ নামের প্রহসনে পাল্টে গেল বাংলার এবং দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ভাগ্য। যুদ্ধের বহুমাত্রিক রাজনৈতিক ধারার ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে পলাশীর ২৬০ বছর পূর্তিতে পূর্বাপর ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরছেন বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম-এর কন্ট্রিবিউটিং এডিটর ড. মাহফুজ পারভেজ। পড়ুন একাদশ পর্ব

কে এই রবার্ট ক্লাইভ? যার সঙ্গে সমৃদ্ধ বাংলার পতন আর অনুপ্রবেশকারী ব্রিটিশের উত্থানের ইতিহাস অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত? পলাশীর ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে যার নাম উচ্চারিত হয়।

সকল ইতিহাসবিদই একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে, ক্লাইভ (২৯ সেপ্টেম্বর, ১৭২৫-২২ নভেম্বর ১৭৭৪) বাংলায় তথা ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠায় মূল ভূমিকা পালনকারী।

সাফল্যের জন্য আর্থিক ছাড়াও বহুবিধ সম্মান লাভ করেন ইংরেজ কোম্পানির কাছ থেকে। তাকে পলাশীর প্রথম ‘ব্যারন’ (যুদ্ধবীর) ছাড়াও মেজর জেনারেল দ্য রাইট অনারেবল দ্য লর্ড ক্লাইভ, কেবি, এমপি, এফআরএস ইত্যাদি সনদ ও সম্মাননায় ভূষিত করা হয় ইংরেজ জাতির ঐতিহাসিক উপকার করার জন্য।

বস্তুতপক্ষে বাংলা ও ভারত অধীনস্থ করার মাধ্যমেই যে ব্রিটিশদের সমৃদ্ধি ও সৌভাগ্য উজ্জ্বলভাবে উদ্ভাসিত হয়, এ কথা সর্বজনবিদিত। আর এ কাজে অন্যতম ভূমিকা পালনকারী ক্লাইভকে সম্মান জানানোই স্বাভাবিক। কিন্ত আশ্চর্যের বিষয় হলো এটাই যে, শেষ দিকে ক্লাইভকে তার স্বজাতি ইংরেজরাই মামলা-মোকাদ্দমা-অপবাদে জর্জরিত করে। ক্লাইভ স্বাভাবিক জীবন থেকে পালিয়ে আত্মহত্যা করে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ থেকে নিষ্কৃতি লাভ করেন। ফলে উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের মতোই ক্লাইভও একটি রোমাঞ্চকর চরিত্র। যোদ্ধা ক্লাইভ

ক্লাইভের আগে ও পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কলকাতাস্থ ফোর্ড উইলিয়ামে বহু স্বনামধন্য ইংরেজ নানা সামরিক ও বেসামরিক পদে দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু ক্লাইভের মতো ইতিহাসখ্যাত ও সফল হন নি কেউই। ক্লাইভ এসেই বাংলার রাজনীতি ও সামরিক পরিস্থিতি অতিদ্রুত ও অতি কৌশলে ইংরেজদের পক্ষে নিয়ে আসেন। ক্লাইভ ভারতে ছিলেন ১৭৪৬ থেকে ১৭৭৪ সাল পর্যন্ত। এসময় তিনি মাদ্রাজ, কর্ণাটকসহ দক্ষিণ ভারতে ফরাসি ও অন্যান্য দেশীয় রাজাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন। কিন্তু বাংলার পলাশী রণাঙ্গনের সাফল্য উপমহাদেশের রাজনীতির পাশাপাশি তার জীবনকেও পাল্টে দেয়।

আয়ারলান্ডের একটি মাঝারি জমিদার পরিবারের সন্তান ক্লাইভ শিক্ষাক্ষেত্রে সাফল্য দেখাতে ব্যর্থ হয়ে ১৭৪৩ সালে নিজের মাত্র আঠারো বছর বয়সে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকরি নিয়ে ভারতের মাদ্রাজে চলে আসেন। তখন সেখানে ইংরেজ ও ফরাসিদের মধ্যে চরম দ্বন্দ্ব চলছিল এবং একে অপরকে পরাজিত করে ভারতবর্ষের অধিকার নেওয়ার জন্য লড়াই করছিল। কর্ণাটকের যুদ্ধে ক্লাইভ একবার ফরাসিদের হাতে বন্দি হন। কিন্তু স্থানীয় লোকের ছদ্মবেশ ধরে পালিয়ে এসে পণ্ডিচেরিস্থ সেন্ট ডেভিড দুর্গে আশ্রয় নেন। এই ঘটনা ক্লাইভকে ১৭৪৮ সালে কোম্পানির বেসরকারি চাকরি ছেড়ে মাদ্রাজ সেনাবাহিনীতে সর্বনিম্ন কমিশন প্রাপ্ত অফিসার পদে যোগদান করতে উদ্বুদ্ধ করে।

ক্লাইভের জীবনীকার ম্যালকমের মতে, তিনি একজন উচ্ছৃঙ্খল অফিসার ছিলেন। কিন্তু উচ্ছৃঙ্খলার সঙ্গে শৌর্যের সমন্বয় ঘটায় উগ্রস্বভাববিশিষ্ট হওয়া সত্ত্বেও ওই সময়ে ক্লাইভের পক্ষে সামরিক কর্তৃত্ব লাভ কঠিন হয় নি। বহু যুদ্ধে তিনি ঝুঁকি, হঠকারিতা ও প্রবঞ্চনার মাধ্যমে প্রচলিত যুদ্ধনীতিকে উপেক্ষা করে কৌশলে বা বাঁকা-পথে জয় ছিনিয়ে আনেন। ১০ বছর ভারতে অবস্থান করে ১৭৫৩ সালের প্রথম দিকে ক্লাইভ লন্ডনে ফিরে গেলে দাক্ষিণাত্যে তার অব্যাহত বিজয়ের কৃতিত্বের জন্য তাকে বীরোচিত সংবর্ধনা দেওয়া হয়। কোম্পানির বোর্ড অব ডাইরেক্টর্স তাকে ‘জেনারেল ক্লাইভ’ পদবীসহ রত্নখচিত তরবারি প্রদান করে। পারিবারিক পরিবেশে ক্লাইভ

উৎসাহিত ক্লাইভ জননেতা হওয়ার লোভে চাকরি পরিতাগ করেন। কিন্তু সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে অমিতাচার ও অসংযত আচরণের জন্য তিনি পার্লামেন্টে আসন লাভ করতে ব্যর্থ হন। তদুপরি লাগামহীন জীবনাচারের ফলে অচীরেই বাংলা থেকে জাহাজ ভরে লুট করে আনা তার ধন-সম্পদ নিঃশেষ হয়ে যায়। দুই বছরের মধ্যে হতাশ ক্লাইভ প্রায়-নিঃস্ব অবস্থায় পুনরায় ভাগ্যান্বেষণে ভারতে রওয়ানা দিয়ে ১৭৫৫ সালে মাদ্রাজ উপস্থিত হলে তাকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল-এর মতো একটি মাঝারি পদ প্রদান করা হয়।

দক্ষিণ ভারতে তখন ফরাসিদের রমরমা অবস্থা ও ইংরেজরা কোণঠাসা। ফরাসিরা হায়দরাবাদের নিজামের সঙ্গে অধীনতামূলক মিত্রতায় আবদ্ধ হয়ে ঊড়িষ্যার পুরি ও কৃষ্ণা নদীর মোহনা পর্যন্ত বিরাট অঞ্চলের কর্তৃত্ব লাভ করে। ক্লাইভ নিজামকে শায়েস্তা করে ফরাসিদের দমনের পথ গ্রহণ করার জন্য কোম্পানিকে উদ্বুদ্ধ করেন এবং মারাঠাদের হাত করে অকস্ম্যাৎ আক্রমণের মাধ্যমে ১৭৫৬ সালে নিজামের শক্তিশালী গেরিয়া দুর্গ অধিকার করেন।

নবাব সিরাজউদ্দৌলার হাতে কলকাতার পতনের সংবাদ এমন সময় মাদ্রাজে পৌঁছে, যখন কোম্পানির লোকেরা ক্লাইভ কর্তৃক নিজামের বিরুদ্ধে সামরিক ও কূটনৈতিক বিজয় অর্জন উপলক্ষ্যে উৎসবে লিপ্ত ছিল। কোম্পানি কর্তৃপক্ষ ক্লাইভকেই কলকাতা পুনরুদ্ধারের উপযুক্ত মনে করেন। এবং ক্লাইভ যথারীতি কলকাতা রওয়ানা হয়ে নগরটি উদ্ধার করেন। সেখানে পর্যুদস্ত ইংরেজ প্রশাসন নিজের কর্তৃত্বে নিয়ে ক্লাইভ অতি দ্রুত রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হন, যার ফলে একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের মাধ্যমে বিরাট সেনাবাহিনীকে হারিয়ে তিনি বাংলার মূল ক্ষমতার অংশীদার হয়ে ওঠেন।

নবাব সিরাজকে হারিয়ে ক্লাইভ মীরজাফরের আগেই মুর্শিদাবাদ পৌঁছান এবং নবাবের খাজাঞ্চিখানার সমুদয় ধন-দৌতল লুট করেন। ষড়যন্ত্রমূলক যুদ্ধের শর্ত অনুযায়ী মীরজাফরকে চাপ দিয়ে টাকা আদায় ও অন্যবিধ লুটতরাজে ক্লাইভ ও তার বাহিনি বাংলায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। তদুপরি চক্রান্তের অংশ হিসাবে ক্ষমতালোভী নানা জনের মধ্যে বিবাদ লাগিয়ে ক্লাইভ এর বিরুদ্ধে ওকে লেলিয়ে দেন। প্রীতিভাজন ও পলাশীর অন্যতম প্রধান ষড়যন্ত্রী  মীরজাফরকে স্বার্থের প্রয়োজনে ছুঁড়ে ফেলতেও ক্লাইভের বিন্দুমাত্র দ্বিধা হয় নি। পরবর্তীতে মীরজাফরের জামাতা মীর কাশেম আলীকে ক্ষমতায় আনা হয়। কিন্তু কিছুটা স্বাধীনচেতা মনোভাবের জন্য তাকেও ইংরেজরা ছাড় দেয় নি।  ক্লাইভের প্রতিনিধি উইলিয়াম ওয়াটস এর হাতে চুক্তিপত্র তুলে দিচ্ছেন মীর জাফর ও তার ছেলে মীর মীরণ, ১৭৫৭

বস্তুতপক্ষে, বাংলার রাজনৈতিক এলিট বা রাজ-দরবারের আমত্যদের পারস্পরিক বিবাদ, দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও পারস্পরিক ষড়যন্ত্রের চাপা-অবস্থাটি পলাশীতে উন্মুক্ত করেন ক্লাইভ এবং পরবর্তীতে এদের মধ্যকার বিবাদকে প্রচণ্ডভাবে উস্কে দিয়ে এই রাজনৈতিক শ্রেণিটিকে ধ্বংস করে দেন। ফলে ইংরেজের পক্ষে বাংলার ক্ষমতা দখলের পথে কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী অবশিষ্ট থাকে নি। ক্লাইভ অত্যন্ত সুকৌশলে মধ্যযুগের বাংলার রাজদরবার কেন্দ্রিক রাজনৈতিক কাঠামোটিকে এমনভাবে ভেঙে দেন যে, আগ্রাসী ইংরেজের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মতো আর কেউ থাকে নি এবং পলাশী-পরবর্তী শতবর্ষকাল কোম্পানি নির্বিবাদে শাসন-শোষণ চালাতে সমর্থ হয়। ১৮৫৭ সালের সিপাহী যুদ্ধের পর কোম্পানি শাসনের অবসান হয়ে ভারতবর্ষে খোদ ব্রিটিশ রানির শাসন চালু হয়।  

তবে, ইতিহাসের এক নির্মম পরিণতি এটাই যে, ক্লাইভ ষড়যন্ত্রমূলক জীবন কাটিয়ে শেষ জীবনে ব্যর্থতা ও জনমানুষের ঘৃণার শিকার হন। নানা অভিযোগ ও অপমানে বেচারি আত্মহত্যা করেন। পলাশীর অপরাপর ষড়যন্ত্রী যথা মীরজাফর, জগৎশেঠ, ঘসেটি বেগম প্রভৃতি সকলেরই অপঘাতে বা অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়।    

শেষ পর্ব
পলাশীর পরাজয়ের পরিণতি

পূর্ববর্তী পর্ব
ষড়যন্ত্রমূলক যুদ্ধের ব্যবচ্ছেদ

বাংলাদেশ সময়: ১৬২০ ঘণ্টা, জুন ২২, ২০১৭
জেডএম/          

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।