ঢাকা, শনিবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

এখানে সকাল আসে পাতি শরালিদের ডাকে

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩০২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৭, ২০১৭
এখানে সকাল আসে পাতি শরালিদের ডাকে বিলের সৌন্দর্য ছড়িয়ে রেখেছে পাতি-শরালিরা-ছবি: বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন

মৌলভীবাজার: দু’দিকেই চা বাগানের হৈমন্তিক শোভা। টিলা ভেদ করে পাকা সড়কটি পৌঁছে গেছে দূর অজানার পানে। চা বাগানের ছায়াগাছগুলোতে তখন ছড়িয়ে পড়ে মিষ্টি রোদের সোনার ঝিলিক। গাছে গাছে পাতায় পাতায় আর প্রকৃতির প্রসারিত অবারিত বুকজুড়ে সূর্যের আলো আর ছায়ার অপরূপ রূপ।

এই দৃশ্যে মনপ্রাণ-চোখ ভরে উঠতে না উঠতেই শোনা যাবে পাতি শরালিদের (Lesser Whistling Duck) ডাকাডাকি। বিলটিতে পৌঁছামাত্র জলচর পাখিদের এমন রোমাঞ্চভরা ডাক শোনা যাবে।

 এমন অবিরল, এমন শ্রবণমধুর ডাক বহুদিন শোনা হয়নি শহুরে নাগরিকদের। ‘হুইহুয়ি-চিচিচি’ এমন ধ্বনির সম্মিলিত স্বরগ্রামে ভরে উঠবে শহুরে মানুষের অনভ্যস্থ কান। প্রকৃতির মুখর-নিবিড় সুর-স্বর কান থেকে দূরে সরিয়ে দেবে মেটালিক শব্দের অট্টরোল। আর টিলাঘেরা এই জনপদের নয়নাভিরাম সৌন্দর্যে অবগাহনের সুযোগ তো আছেই।  

এই পাতি-শরালিদের ডাক শুনে হৃদয় জুড়ায়। তাদের জলকেলি দেখে আপনা থেকেই ভরে ওঠে প্রাণ! জলচর এইসব হাঁসেদের ডাকেই সকাল আসে এখানে নিত্যদিন। হাঁস আর নানা প্রজাতির পাখিরা তাদের সম্মিলিত ডাকাডাকির মধ্য দিয়ে রাত্রির অন্ধকার থেকে ঝলমলে ভোরকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে যেন।

মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার রাজঘাট চা বাগানের এই বিল-টিলাঘেরা নৈসর্গিক শোভা ছড়িয়ে থাকে আদিগন্ত। চা বাগান কর্তৃপক্ষের বিধিনিষেধ আর লোকচক্ষুর অন্তরালে পড়ে থাকার কারণে এটি প্রকৃতিপ্রেমীদের অদেখাই রয়ে গেছে।

বিলের সৌন্দর্য ছড়িয়ে রেখেছে পাতি-শরালিরা-ছবি: বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপনরোববার (৩ ডিসেম্বর) সকাল সাড়ে এগারোটায় এই বিলে পৌঁছে দেখা যায়, পাতি-শরালিসহ জলচর পাখিদের সরব উপস্থিতি। জলকেলির সাথে পরস্পরের সঙ্গে নিবিড় আলাপনে মগ্ন ওরা। বিলজুড়ে ফুটে রয়েছে অসংখ্য শাপলা-পদ্ম। লাল শাপলার অসীম প্রাচুর্য বিলটিকে দিয়েছে নয়নমোহন শোভারূপ।   

লেকের পুব পাশ ঘেঁষে নীরবে চলে গেছে সরু একটি পথ। এ পথটি মাটির। তবে এর কিছু অংশ ঘাসে ঢাকা।  সেই পথ ধরে এগোতেই বিলের আঁকাবাঁকা বাঁক। একপাশে চা গাছের সবুজ সারি, অন্যপাশে বিলের কাকচক্ষু জলের শোভা। সবকিছুকে ছাপিয়েই এই জলচর পাখিদের মোহন-মধুর ক্ষণিক ডাকাডাকি।  

বিলের পাশ ঘেঁষা মাটির পথ ধরে কখন যে পাতি-শরালিদের এতোটা কাছে এসে পড়েছি, তা তখনই কেবল টের পেলাম যখন দেখলাম ওদের একটা ঝাঁক ঝটিতি ডানা মেললো । আহা, ডানার কী অপূর্ব শব্দ! বাতাস কেটে চলা ওদের ডানার পালকের ভাঁজে ভাঁজে কেমন এক আওয়াজ যেন পাক খেয়ে খেয়ে কানে এসে লাগে। শ্রবণবাহিত হয়ে চেতনায় বাজে যেন সৌন্দর্যধ্বনির এক অনন্ত আহ্বান।

বিলের সৌন্দর্য ছড়িয়ে রেখেছে পাতি-শরালিরা-ছবি: বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন
হঠাৎ দেখা গেল বিলের এক কোণে পানিতে বৃত্তাকার ঢেউ তুলে এগিয়ে আসছে একটি মাঝারি আকৃতির সাপ। কাছে আসতেই ঢোঁড়া সাপের পরিচিতি মেলে ধরলো সে। তারপর তার অবাক করা ডুব! আর দেখা গেল না; গেলই না।    

বিলের জল দারুণ স্বচ্ছ। তাতে দল বেঁধে ঘুরে বেড়ানো মাছের ছানাদের বেশ দেখা যায়। ছোট ছোট মৎস্যছানারা প্রজননধারার নতুন অতিথি হয়ে বিলের সৌন্দর্যে যোগ করেছে নতুন মাত্রা।   

‘মাঝে মাঝে এখানে পাখি শিকার হয়’ – স্থানীয় এক ব্যক্তির সাথে আলাপকালে এই ভয়ংকর বাক্যটি শুনে মন খারাপ হয়ে গেল। তিনি কথার সূত্র ধরে আরো এগোলেন। ‘খুব ভোরে একবার শরালি হাঁসগুলো শিকার করার গুলির শব্দ শুনেছি। পরে এই গুলির শব্দের কথা দু’-একজন আমাকে জানিয়েছিল। ’ 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজঘাট চা বাগানের ওই ব্যক্তি আরো বলেন, ‘স্থানীয়ভাবে এই বিলের নাম 'মনঝিল'। বর্তমানে রাজঘাট বাগান ম্যানেজমেন্ট এখানে সর্বক্ষণিক পাহারার ব্যবস্থা করেছে। তারপরেও ভোর রাতের দিকে এখানে পাখি শিকার করা হয় বলে শুনেছি। ’

পাতি শরালিরা আকার-আকৃতিতে আমাদের গৃহপালিত হাঁসের মতো। বাদামি দেহের জলচর পাখি। ওদের মাথায় কালচে রঙের চাঁদি (মাথার উপরের উঁচু অংশ) রয়েছে। ওদের শরীরের দৈর্ঘ্য ৪২ সেন্টিমিটার। শীতমৌসুমে ওরা হাওর, বিল, জলাশয়গুলোতে অস্থায়ীভাবে কয়েকটি দলে বসবাস করে থাকে ওরা।
 
বন্দুকের গুলিতে নয়। এই বিলের জলচর পাখিরা বাঁচুক মানুষের ভালোবাসায়। আমাদের হৃদয়ের নিভৃত ভালোবাসা কি প্রকৃতির এই সব নিরীহ বন্ধুদের বাঁচাতে পারে না! ফিরে আসার সময় পাখি শিকারের বিষয়টি চেতনার সৌন্দর্যবোধের ভেতর একটি রক্তপূঁজময় ক্ষত হয়ে বেদনা ছড়াতে থাকলো।  
 
বাংলাদেশ সময়: ০৯০২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৭, ২০১৭
বিবিবি/জেএম
 
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।