ঢাকা, শনিবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যস্থান হাম্পি সাম্রাজ্যে

শুভ্রনীল সাগর, ফিচার এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০০৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৮, ২০১৭
ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যস্থান হাম্পি সাম্রাজ্যে বিশ্ব ঐতিহ্যস্থান হাম্পি সাম্রাজ্যে। ছবি: বাংলানিউজ

হাম্পি ঘুরে: কমলাপুরা মোড়ে এসে গুগল ম্যাপের পথ-প্রদর্শক জানালো, নিতে হবে বাম দিকের রাস্তা। চড়াই-উৎরাই পথ। দু’ধারে নারকেল গাছের সারি, এর পিছনে ছোট-বড় পাহাড়। নানা আকৃতির পাথরে সাজানো পাহাড় বলাই ভালো— ছোটবেলায় আমরা যেমন সাত-চাড়া সাজাতাম, ঠিক তেমন।

সূয্যিমামা কেবল আড়মোড়া ভাঙতে শুরু করেছেন। আসন্ন পৌষের আমেজে তাকেও যেনো খানিকটা আলসে লাগে।

গন্তব্য এখনও চার কিলোমিটার দূরে। আর যেনো তর সয় না! তখন প্রায় নিশুতি রাত, সোয়া চারটেয় যাত্রা করে বাইক ঠেলে হায়দ্রাবাদ থেকে এই অব্দি আসা চারটিখানি কথা নয়। পথিমধ্যে চা-বিস্কুটের বিশ্রাম বাদ দিলে নগদ ৩৭৯ কিমি। কিন্তু ইতোমধ্যে ফেসবুকে বাম-রাজনীতিকালের হিরো চে গ্যেভারার ‘মোটর সাইকেল ডায়ারিজ’ হ্যাশট্যাগ দেওয়া হয়ে গেছে এবং অবশ্যই অবশ্যই লক্ষ্য যখন ‘হাম্পি’ তখন উৎসাহ-উদ্দীপনা স্বাভাবিকভাবেই আটগুণ! বিশ্ব ঐতিহ্যস্থান হাম্পি সাম্রাজ্যে।  ছবি: বাংলানিউজ
হাম্পি সম্পর্কে এক লাইনে বললে, ইউনেস্কোর তালিকাভুক্ত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। ভৌগলিকভাবে এটি ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের একটি গ্রাম এবং ঐতিহাসিকভাবে খ্রিস্টাব্দ ১৪ শতকের বিজয়নগর সাম্রাজ্যের রাজধানী— যার ৪১ হাজার হেক্টরজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে সেসময়কার দূর্গ, রয়্যাল কমপ্লেক্স, কুঠি, মণ্ডপ, পিলার হল, কলাকেন্দ্র, স্মারক নিদর্শন, প্রাসাদ, ঘর-বাড়ি, মন্দির প্রভৃতির ধ্বংসাবশেষ। বিশ্ব ঐতিহ্যস্থান হাম্পি সাম্রাজ্যে।  ছবি: বাংলানিউজ
 খ্রিস্টাব্দ ১৪ থেকে ১৬ শতকের মধ্যে যেসব পর‌্যটক ভারতে এসেছেন, তারা প্রত্যেকেই তৎকালীন হাম্পি নগরীরর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। কেউ কেউ উল্লেখ করেন, মধ্যযুগে বেইজিং-এর পরে সবচেয়ে বড় শহর ছিলো হাম্পি এবং একইসঙ্গে ভারতের সবচেয়ে ঐশ্বর‌্য আর সম্পদশালী নগরী।  
 
হাম্পির সঙ্গে সঙ্গে চলে আসে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের কথা। চতুর্দশ শতাব্দীতে (১৩৩৬ খ্রি.) সঙ্গমের দুই পুত্র, প্রথম হরিহর (হুক্কা) ও বুক্কা রায়া (বুক্কা) আদি গুরু শঙ্করাচার্যের স্থাপিত শৃঙ্গেরী মঠের গুরু বিদ্যারণ্যের নির্দেশ ও প্রভাব মান্য করে এই বিজয়নগর সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। গুরুর প্রভাব শুধু এই দুই ভাইয়ের ওপরই সম্পূর্ণরূপে প্রতিফলিত ছিলো তাই নয়, পরবর্তী প্রায় ২শ বছর ধরে এই সাম্রাজ্যের প্রত্যেক রাজার ওপরই প্রভাব বহাল ছিলো। ১৫১০ খ্রিষ্টাব্দে কৃষ্ণদেব রায়া রঙ্গ-মণ্ডপের একটি ছবিতে পরিব্রাজক রূপে গুরু বিদ্যারণ্যকে দেখিয়েছেন বলে প্রত্নতাত্ত্বিকদের মত। ছবিটি এখনও হয়তো রয়েছে কিন্তু হাজার হাজার পাথরে খোদাই করা ছবির ভিড়ে সাধারণ পর‌্যটকদের সেটি আলাদা করে চেনা মুশকিল। বিশ্ব ঐতিহ্যস্থান হাম্পি সাম্রাজ্যে।  ছবি: বাংলানিউজ
 ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষভাগে দক্ষিণ ভারতে তুর্কিদের আক্রমণ প্রতিহত করে এই সাম্রাজ্য নিজস্ব প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়। ১৬৪৬ সাল পর্যন্ত এই সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব ছিলো। তবে ১৫৬৫ সালে দাক্ষিণাত্য সুলতানির নিকট যুদ্ধে পরাজিত হয়ে এই সাম্রাজ্যের পতনের সূত্রপাত ঘটলেও, দক্ষিণ ভারত তথা ভারতবর্ষের ইতিহাসে আলাদা গুরুত্ব নিয়ে থাকবে বিজয়নগর সাম্রাজ্য।
 
দক্ষ প্রশাসন ও বৈদেশিক বাণিজ্যের কল্যাণে এই সাম্রাজ্যের রাজারা জলসেচের নতুন প্রযুক্তি আমদানি করেন। বিজয়নগর সাম্রাজ্য শিল্প ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলো। কান্নাড়া, তেলুগু, তামিল ও সংস্কৃত সাহিত্যে এই সাম্রাজ্যের পৃষ্টপোষকতায় এক নতুন যুগের সূচনা হয়। কর্ণাটকী সঙ্গীত এই সাম্রাজ্যের রাজত্বকালেই তার বর্তমান রূপটি লাভ করে। বিশ্ব ঐতিহ্যস্থান হাম্পি সাম্রাজ্যে।  ছবি: বাংলানিউজ
 প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, এই সাম্রাজ্যের নিদর্শন স্বরূপ নানা স্থাপত্য ছড়িয়ে রয়েছে সমগ্র দক্ষিণ ভারতজুড়ে। সাম্রাজ্য ধ্বংসের প্রায় ৪শ বছর পরেও সেসব স্থাপত্যের সংখ্যা ১৬ হাজারেরও বেশি। স্থানীয় গ্র্যানাইট পাথরে বিজয়নগর স্থাপত্যের এই শৈলী গড়ে ওঠে। এর শ্রেষ্ঠ নিদর্শন অবশ্যই হাম্পি।
 
স্থানীয় ভাষায় হাম্পিকে বলা হয় পাম্পা-ক্ষেত্ৰ, কৃষকৃন্দ ক্ষেত্ৰ অথবা ভাষ্করা ক্ষেত্ৰ। ভাষ্কর নামটি পাম্পার থেকে উৎপত্তি হয়েছে, যা তুঙ্গভদ্ৰা নদীর প্ৰাচীন নাম। প্রাচীন সব সভ্যতা ও শহর কোনো না কোনো নদী, সমুদ্র তথা জলের উৎসকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। সেই নিয়ম মেনে হাম্পিকে জলস্পর্শ দিয়ে বয়ে গেছে তুঙ্গভদ্ৰা নদী, যা হাম্পির সৌন্দর‌্যকে বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ। বিশ্ব ঐতিহ্যস্থান হাম্পি সাম্রাজ্যে।  ছবি: বাংলানিউজ
 উল্লিখিত ১৬ হাজারের বেশি নাম জানা-অজানা নিদর্শনের কথা বাদই দিলাম, আর্কেওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার তালিকাভুক্ত হাম্পির ‘অবশ্য দর্শনীয়’ ৮৩টি প্রত্নতাত্ত্বিক বিস্ময় ঘুরে দেখতেই দু’-তিন দিন লেগে যায়। তখন দর্শনার্থীদের অবস্থা হয়, শ্যাম রাখি না কুল রাখি অর্থাৎ কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখবো!
 
খুব কাটছাট করলেও- বিরুপক্ষ মন্দির, ভিত্তালা মন্দির, হেমকূট জৈন মন্দির, কৃষ্ণ মন্দির, নরসিংহ, আন্ডারগ্রাউন্ড শিব মন্দির, বড়লিঙ্গ মন্দির, হাজার রামের মন্দির, হনুমান মন্দির, গণেশ মন্দির, কিংস ব্যালেন্স, কুইনস বাথ, লোটাস মহল, হাতিশালা প্রভৃতি না দেখলেই নয়। এসবের গল্প ও বিস্তারিত অন্য পর্বে নিশ্চয় হবে। বিশ্ব ঐতিহ্যস্থান হাম্পি সাম্রাজ্যে।  ছবি: বাংলানিউজ
ভৌগলিকভাবে হাম্পির অবস্থান কর্ণাটকার হসপেট শহরের কাছে (প্রায় ৯ কিমি)। যাওয়া যাবে হায়দ্রাবাদ এবং কর্ণাটকার রাজধানী ব্যাঙ্গালুরু থেকেও। ট্রেন, বাস, ক্যাব বা মোটরবাইক— হাম্পি এতোই জনপ্রিয় জায়গা যে কোথাও কোনোকিছুতে বাধবে না। দিনপ্রতি পাঁচশো-ছয়শোর মধ্যে থাকা যাবে মনোরম হোটেলে। আর খাওয়া নিজের উপর। রোজ প্রচুর বিদেশি পর‌্যটক বেড়াতে আসে বলে সাউথ ইন্ডিয়ান খাবারের পাশাপাশি মিলবে মাল্টি-ন্যাশনাল কুইজিনও।
 
এতো গেলো খুটিনাটি তথ্য, ভারত ভ্রমণকালে অবশ্যই ব্যাগপ্যাক নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন হাম্পির পথে। মোবাইলে নেটওয়ার্ক থাকবে না, চারপাশে সুউচ্চ পাহাড়, উপত্যকাজুড়ে নারকেল গাছের সারি, গাড় সবুজ কলাক্ষেত, এঁকেবেঁকে বয়ে চলা তুঙ্গভদ্রা নদী এবং মুখোমুখি আপনি আর ১৪ শতকের হাম্পি নগরী…
 
বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৮, ২০১৭
এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।