এলো চুলের চেহারা দেখলেই বোঝা যায়, চোখ থেকে এখনো ঘুম সরেনি। তবে এই শীত সকালে লেপের ওমটুকু ছেড়ে বকুল তলায় কেন? প্রশ্ন করতেই আলতো হাসিতে উত্তর দিল সে, খেজুরের রস খেতে!
নৌমিতার এ উত্তরে অবাক হবারই কথা! বকুলতলায় আবার খেজুর রস পাওয়া যায় নাকি? বকুলতলায় তো খুব সকালে সবাই ফুল কুড়োতে আসে।
মেলায় খেজুরের রসের সাথে সাথে পাওয়া যাচ্ছে খেজুরের গুড়, খই আর মুড়িও। ঠিক যেন শীতের দিনে গ্রামের সকালের নাশতা। মাটির ছোট হাঁড়িতে ঠোঁট ছুইয়ে নৌমিতা যখন খেজুর রসের স্বাদ নিতে ব্যস্ত, ততক্ষণে বকুলতলা ভরে গেছে রসপ্রেমীদের পদচারণায়। তাদের মধ্যে যেমন মাটির হাঁড়ি বা মাটির গ্লাসে করে খেজুরের রস খাচ্ছিলেন, তেমনি অনেকেই শুকনো পাতার তৈরি বাটি থেকে স্বাদ নিচ্ছিলেন খই, মুড়ি আর খেজুর গুড়ের। খেতে খেতেই একে অপরের সঙ্গে মেতে উঠেছিলেন রসবোধে।
কথা হলো রসের মেলোয় আগত আব্দুস সামাদের সঙ্গে। বাংলানিউজকে জানালেন, প্রায় ১৮ বছর পর রস খাচ্ছেন তিনি। কারণ জানতে চাইলে বলেন, খেজুরের রসতো শহরে খুব কম পাওয়া যায়। আর ঢাকাতে চাকরির সুবাদে গ্রামেও যাওয়া হয় খুব অল্প। সে কারণেই দীর্ঘ সময় এ পানীয়ের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়ে আছি। তবে আজ এটা পেয়ে ভীষণ ভালো লাগছে।
এ সময় মেলায় খেজুর রসের জন্য দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে অনেককেই। শুক্রবার সকালের নাশতাটা তারা বকুল তলায় সেরেছেন খেজুর রস, নলেন গুড় আর খই মুড়িতে।
মেলা প্রাঙ্গণে বাংলানিউজর কথা হয় বাংলা একাডেমির ফোকলোর বিভাগের পরিচালক শাহিদা বেগমের সঙ্গে। রসের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে তিনি জানান, শৈশব-কৈশোরটা যাদের গ্রামে কেটেছে, খেজুর গাছ থেকে রসের হাঁড়ি চুরি করে রস খাওয়া তাদের অনেকেরই একটি মূল্যবান স্মৃতি। এখন তো অনেকেই বয়সের ভারে নতজানু। অনেকেই আবার শহরে কাজের ব্যস্ততায় সঠিক সময়ে গ্রামে যেতে পারেন না। ফলে অনেকেই এ জায়গাটা থেকে বেশ ভালোভাবে বঞ্চিত হয়।
শাহিদা বেগম বলেন, আমাদের ছেলেমেয়েরা আজ বিভিন্ন ধরনের কোমল পানীয়ের স্বাদ জানে, কিন্তু তারা খেজুর রসের স্বাদ জানে না। খেজুর রস আমাদের আর পাঁচটা সংস্কৃতির মতোই। আমাদের উচিত এটার প্রতি আরো যত্নবান হওয়া। আমরা অতীতমুখী নই, তবে সেখান থেকে আমাদের শিখতে হবে। আমরা কখনোই ঐহিত্য বিমুখ হতে চাই না।
বাঙালির রসবোধ সর্বজন বিদিত। বাঙালির চিন্তা মননে রসবোধ আগেও ছিলো, এখনো আছে। সে রসবোধকে আরো রসালো করতেই যেন শহুরে জীবনে এ রসের মেলার আয়োজন। তাইতো মেলায় তরুণ-তরুণী আর বয়স্কদের সাথে হাত ধরে হেঁটেছে ছোট্ট শিশুরাও। সবার সঙ্গে তারাও নিয়েছে ঐতিহ্যের স্বাদ ও ঘ্রাণের বোধ। এ বোধ শক্তিই সবাইকে পুরোদস্তুর বাঙালি হতে সাহায্য করবে বলে মনে করেন সংস্কৃতিজনেরা।
বাংলাদেশ সময়: ১১৫০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৯, ২০১৮
এইচএমএস/এমজেএফ