ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

মহানন্দার পাথরে ঘুরছে জীবনের চাকা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪৫৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩১, ২০১৮
মহানন্দার পাথরে ঘুরছে জীবনের চাকা মহানন্দার বুকে জীবিকার খোঁজ।

তেঁতুলিয়া (পঞ্চগড়) থেকে ফিরে: গেলো বছরের ডিসেম্বরের ৩০ তারিখ, শীত তখন বেশ ভালোভাবেই জেঁকে বসেছিল। পঞ্চগড় শহর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে তেতুঁলিয়ায় জেলা পরিষদ ডাকবাংলোয় যখন পা পড়লো তখন গড়ির কাঁটায় ঠিক সকাল সাড়ে ৮টা।

কুয়াশা তখনো কাটেনি, বাংলোর এক পাশে দাঁড়িয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা আর হিমালয় দেখছিলাম ক্যামরার ভিউ ফাইন্ডারে। পাথর শনাক্তের লোহার রড দিয়ে নদী থেকে পাথর তুলছে শ্রমিকক্লিক বাটনে আঙুল আর পড়ছিল শাটার, ক্লিক করতে করতে যখন চোখে ক্লান্তি, ঠিক তখনই দৃষ্টি পড়লো মহানন্দার বুকে।

ওপাশটা ভারতীয় কাটাঁতারে ঘেরা, এ পাশটা বাংলাদেশ। দু’দেশের সীমানার উপর দিয়েই মহানন্দার চলাফেরা। হিমালয়ে কোলঘেঁষা মহানন্দার পানি থেকে ধোঁয়া উঠছিল তখনও। দূর থেকেই আঁচ করা গেল বেশ ঠাণ্ডা হবে মহান্দার জল। কিন্তু তাতে কি? তবুও থেমে নেই মহানন্দা পাড়ের মানুষের কর্মব্যস্ততা। বাতাসে ফুলানো গাড়ির চাকার টিউবের ভেলায় পাথর তুলছেন এক শ্রমিক পাথর নিয়ে কর্মযজ্ঞ। নদী থেকে দল বেঁধে পাথর তোলা। নদীর বুকে কর্মব্যস্ত মানুষগুলো মহানন্দারই সন্তান, তাদের বলা হয় পাথর শ্রমিক।

নদীতে নেমে পাথর শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা গেল তাদের জীবন যাপন ও মহানন্দার গল্প। তারা জানান, এককালে অভাব-অনটন ছিল এখানকার মানুষের নিত্যসঙ্গী। এখন আর সে অবস্থা নেই, পাল্টেছে জীবনের দৃশ্যপট। মহানন্দার পাথর তুলে যে আয় হয় তা দিয়েই ঘুরে তাদের জীবনের চাকা।

কেউ পাথর তুলছেন। আবার কেউ নদীরঘাট থেকে সে পাথর কিনে এনে মেশিনের কাছে দিচ্ছেন। কেউবা মেশিন চালিয়ে রোজগার করছেন, আবার কেউ ট্রাকে পাথর লোড-আনলোড করছেন। অনেকে আবার কারবারিদের কাছে পাথর সরবরাহ করছেন। এই করেই চলছে দেশের সর্ব উত্তরের জনপদ তেতুঁলিয়ার মানুষের জীবন।

জানা গেল, দিন দিন পাথরের চাহিদা বাড়ায় এলাকায় এখন আর কাজের অভাব হয় না। পাথরজীবীরা এখন পেটভরে তিন বেলা খেয়ে ভবিষ্যতের জন্যও খানিকটা জমাতে পারেন। ভারত থেকে বয়ে আসা মহানন্দা নদীর পাথর এই অঞ্চলের মানুষকে বিনা পুঁজিতে আয় করার সুযোগ তৈরি করেছে, হাজার হাজার পরিবারে এনে দিয়েছে কর্মসংস্থান এবং স্বচ্ছলতা। গাড়ির চাকার টিউবের ভেলা থেকে উপরে পাথর তুলে আনছেন এক শ্রমিকআর তাইতো মহানন্দার পাথরই তাদের বেঁচে থাকার অন্যতম অবলম্বন এখন।

মহানন্দা নদী নিয়ে কথা হয় পঞ্চগড় মহিলা কলেজের সহযোগী অধ্যাপক মো. মজিবুর রহমানের সঙ্গে। তিনি জানান, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলার মহালিদ্রাম পাহাড় থেকে উৎপত্তি হয়ে পশ্চিবঙ্গের উত্তরাংশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে আবার ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলা হয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে নদীটি। বাংলাদেশে পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা থেকে শুরু করে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত ১৫ থেকে ১৬ কিলোমিটার দু’দেশের সীমানা দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে মহানন্দা। মূলত এই অংশটুকুর মধ্যেই পাথর উত্তোলন করা হয়।

মহানন্দা নদীর বাংলাদেশের যে অংশটুকুর মধ্যে পাথর উত্তোলন করা হয় এর এক পাশে তেঁতুলিয়া অন্য পাশে ভারতের হাতিয়া গছ ও শিলিগুড়ি। নদীটির উজানে ভারতের ফুলবাড়িতে রয়েছে স্লুইস গেইট। ভারত এ গেইট বন্ধ রাখে আবার কখনও খুলে দেয়। খুলে দিলেই পানির স্রোতের সঙ্গে ভেসে আসে বিভিন্ন আকৃতির পাথর।  সেই পাথরেই জীবিকা তেঁতুলিয়াসহ পঞ্চগড়ের অধিকাংশ মানুষের।

কথা হয় পাথর শ্রমিক চলিশোর্ধ্ব রফিক মিয়ার সঙ্গে। তিনি জানান, মহানন্দায় পাথর রয়েছে তা অনেক আগে থেকেই জানতো মানুষ। কিন্তু পাথরের দাম ছিল না। এখন পাথরের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষ কায়িক প্ররিশ্রম করে টাকা রোজগার করে খেয়েপড়ে বাঁচতে পারছে সাচ্ছন্দ্যে।

রফিক মিয়া জানান, সারাদিন কাজ করে ৫শ’ থেকে ৭শ’ টাকা পর্যন্ত আয় করা যায়। তবে এর জন্য করতে হয়ে অমানবিক পরিশ্রম। ঝরাতে হয় গতরের ঘাম। শুধু পুরুষ নয়- পাথরের কাজে অংশ গ্রহণ করতে পারেন নারীরাও। একজন নারী সারাদিন কাজ করলে ৩শ’ থেকে ৪শ’ টাকা রোজগার করা সম্ভব।

বাংলাদেশ সময়: ১০৫৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩১, ২০১৮
এসএইচডি/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।