জানা যায়, সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহ’র শাসনামলে (১৪৯৩-১৫১৯ সাল) ওয়ালি মোহাম্মদ নামে এক ব্যক্তি এই মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। মসজিদটি ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম স্থাপত্যের একটি অন্যতম নিদর্শন।
তবে অযত্নে সোনা মসজিদের সেই সোনালি রং এখন আর নেই। এখন তামাটে রঙে পরিণত হয়েছে। জানা গেছে, মসজিদটি নির্মাণের সময় এর যে খিলানপথ ছিল সেগুলোতে কোনো দরজা ছিল না। পরে সেখানে দরজা লাগালেও সেগুলো এখন অত্যন্ত নড়বড়ে। আর ভেতরের ইটগুলো যাচ্ছে খসে।
তবে এখনও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা হয় প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো মসজিদটিতে। তাছাড়া থাকে প্রতিবছর রমজান মাসে বিশেষ ইফতারের আয়োজন। দাতাদের ইফতারিতে রমজানের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিদিন প্রায় ৪০০ লোকের ইফতারের আয়োজন করা হয় এখানে।
মসজিদের মূল গেটের দক্ষিণ পাশেই দুইজন বিশিষ্ট ব্যক্তির কবর। সেখানে শুয়ে আছেন বীরশ্রেষ্ঠ শহিদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর নাজমুল হক। আর মসজিদের বাইরে পূর্ব দিকে রয়েছে সুলতান আলাউদ্দিন শাহ ও তার স্ত্রীর কবর। এরপাশেই শায়িত আছেন সুলতানের পরিবারের আরও অনেকে।
মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে ৮২ ফুট লম্বা ও পূর্ব-পশ্চিমে ৫২.৫ ফুট চওড়া। উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট। এর দেয়ালগুলো প্রায় ৬ ফুট পুরু। দেয়ালগুলো ইটের তৈরি হলেও ভেতরে ও বাইরে পাথর দিয়ে ঢাকা। মসজিদের খিলান ও গম্বুজগুলোও ইটের তৈরি। তবে কোথাও রড-সিমেন্টের ব্যবহার নেই। মূলত চুন-শুরকি দিয়েই গড়া।
মসজিদের চারদিকে চারটি বুরুজ আছে। এই বুরুজগুলোর নকশা আটকোণা। বুরুজগুলোতে ধাপে ধাপে বলয়ের কাজ আছে। এগুলোর উচ্চতা ছাদের কার্নিশ পর্যন্ত।
মসজিদের পূর্ব দেয়ালে পাঁচটি খিলানযুক্ত দরজা আছে। খিলানগুলো বহুভাগে বিভক্ত। উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে আছে তিনটি করে দরজা। তবে উত্তর দেয়ালের সর্ব-পশ্চিমের দরজাটির জায়গায় রয়েছে সিঁড়ি। এই সিঁড়িটি উঠে গেছে মসজিদের অভ্যন্তরে উত্তর-পশ্চিম দিকে দোতলায় অবস্থিত একটি বিশেষ কামরায়। কামরাটির অবস্থান পাথরের স্তম্ভের ওপর। মসজিদের গঠন অনুসারে এটিকে জেনানা-মহল বলেই আখ্যায়িত করা হয়। তবে অনেকের মতে এটি জেনানা-মহল ছিল না, এটি ছিল সুলতান বা শাসনকর্তার নিরাপদে নামাজ আদায়ের জন্য আলাদা একটি কক্ষ। আবার অনেকের মতে আগে ইসলামী শরিয়াভিত্তিক যে বিচার হতো, সেই বিচার কাজের জন্যই সুলতান এখানে বসতেন। এখানেই বসেই বিভিন্ন বিবাদের মীমাংসা করতেন তিনি।
মসজিদের অভ্যন্তরে রয়েছে ৮টি স্তম্ভ ও চারপাশের দেয়ালের ওপর তৈরি হয়েছে ১৫টি গম্বুজ। এ গম্বুজগুলো চৌচালা ঘরের মতো দেখতে। এর দু’পাশে দুই সারিতে তিনটি করে মোট ১২টি গম্বুজ রয়েছে। এই গম্বুজগুলো অর্ধ-বৃত্তাকার। এ মসজিদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, বাইরের যেকোনো পাশ থেকে তাকালে কেবল পাঁচটি গম্বুজ দেখা যায়, পেছনের গম্বুজগুলো দৃষ্টিগোচর হয় না।
প্রতিদিন দেশ বিদেশ থেকে বহু পর্যটক এই মসজিদ দেখার জন্য হাজির হন। অনেকে আবার এখানে এসে নামাজ আদায় করেন।
মসজিদের ইমাম মো. হিজবুল্লাহ বাংলানিউজকে বলেন, এই প্রাচীন ঐতিহ্যটি এখন বেশ ঝুঁকিতে রয়েছে। কারণ, মসজিদের পাশে দিয়ে স্থল বন্দরের সড়ক চলে গেছে। সেই সড়ক দিয়ে প্রতিদিন প্রায় কয়েক’শ ভারি ট্রাক চলাচল করে। যখন ট্রাকগুলো যায় মসজিদটিতে কম্পন সৃষ্টি হয়, মনে হয় এই বুঝি ভেঙে পড়লো। তাছাড়া অনেক জায়গায় ফাটল ধরেছে।
ঐতিহ্যবাহী এই প্রাচীন মসজিদটি সংরক্ষণ ও সংস্কারের জন্য সংশ্লিষ্ট মহলের দৃষ্টি কামনা করেন তিনি।
মসজিদটি পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করেছে স্থাপত্য অধিদপ্তর। এখন মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বের রয়েছে জেলা প্রশাসন।
ইমাম মাওলানা মো. হিজবুল্লাহ বলেন, এই মসজিদে ঐতিহ্য ধরে রাখতে আমরা রোজার ৩০ দিন ৩০ জনকে ঠিক করে দিয়েছি, তারাই প্রতিদিন ইফতারির আয়োজন করে থাকেন। এখানে প্রায় ৪০০ লোককে ইফতার করানো হয়। তাছাড়া চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সবচাইতে বড় ঈদ জামায়াত এই সোনা মসজিদে হয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩০ ঘণ্টা, জুন ০১, ২০১৮
এসএম/এনএইচটি