ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

জসীম মণ্ডল: গণমানুষের মুক্তি আন্দোলনের একজন পুরোধা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২১৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ২, ২০১৮
জসীম মণ্ডল: গণমানুষের মুক্তি আন্দোলনের একজন পুরোধা জসীম মন্ডল: গণমানুষের মুক্তি আন্দোলনের একজন পুরোধা

ইশ্বরদী (পাবনা): সুস্থ থাকাকালে স্মৃতিচারণে তিনি বলেছেন, তার বাবা হাউস উদ্দিন মণ্ডলও রেলস্টেশনে শিলিগুড়িতে চাকরি করতেন। ১৯২৫ সালে তার বাবা বদলি হন সৈয়দপুরে। কিশোর বয়সেই জসিম মণ্ডল দেখা পেয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী, মাস্টারদা সূর্য সেন, বাঘা যতীন, প্রীতিলতার।

অল ইন্ডিয়া কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজফ্ফর আহ্‌মদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে তার সৌভাগ্য হয়েছিল বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে দেখার। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের সাম্নিধ্যেও এসেছিলেন তিনি।

আর এই সবকিছুই তাকে তৈরী করেছে গণমানুষের মুক্তি আন্দোলনের একজন পুরোধা হিসেবে।

কমরেড জসীম উদ্দিন মন্ডল। বাংলাদেশের বামপন্থী বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম বর্ষীয়ান এক নেতা তিনি। একই সঙ্গে প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এ সংগঠক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও যোগ দিয়েছিলেন সৈনিক হিসেবে। তখন তার কাধে লেখা ছিল 'আই.ই (ইন্ডিয়ান ইঞ্জিনিয়ার্স)'। মুম্বাই, মাদ্রাজসহ বিভিন্ন বন্দর থেকে যেসব কামান, বারুদের গাড়ি আসত, সেগুলো ট্রেনে আসামে পৌঁছে দিতেন। ট্রেনের ইঞ্জিনের বয়লারে কয়লা ভরতেন। ১৯৪০ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত যুদ্ধে নানাবিধ সাহায্য করেছেন দীর্ঘজীবি বটবৃক্ষের ন্যায় এ মানুষটি। গণমানুষের মুক্তি আন্দোলনে সবসময়ই কথা বলে গেছেন জসীম মন্ডলব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক অথবা কিংবদন্তি শ্রমিক নেতা কমরেড জসিম উদ্দিন মন্ডলের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আজ (২ অক্টোবর) মঙ্গলবার। এ উপলক্ষ্যে পাবনার ঈশ্বরদী শহরের পশ্চিম টেংরীতে তার নিজ বাসভবনে কোরআনখানি, পশ্চিমটেংরী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে স্বরণসভা, দোয়া মাহফিল ও মোনাজাত এবং নাগরিক কমিটি ও সুশিল সমাজের পক্ষ থেকে পালন করা হবে নানাবিধ কর্মসূচি।

১৯২০ সালে কুষ্টিয়া জেলার কালীদাশপুরে জন্মগ্রহণ করা এ বামপন্থী নেতার বাবার নাম হাউস উদ্দীন মণ্ডল, মা জহুরা খাতুন। বাবা চাকরি করতেন রেলে। চাকরির সুবাদে সিরাজগঞ্জ, রানাঘাট, পার্বতীপুর, ঈশ্বরদী, কোলকাতায় বসবাস করেছেন দীর্ঘদিন। এসময় বাবার সাথে কোলকাতায় নারকেলডাঙা রেল কলোনিতে বসবাসকালে মাত্র ১৩-১৪ বছর বয়সেই মিছিলে যোগ দিয়ে জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে। তারপর থেকেই চিন্তা দেশ আর দেশের মানুষকে নিয়ে।

১৯৪০ সালের মাঝামাঝিতে শিয়ালদহে মাসিক ১৫ টাকা মাইনেতে রেলের চাকরিতে যোগ দেওয়া এ রাজনৈতিক নেতা চাকরির পাশাপাশি ক্রমেই লাল ঝাণ্ডার একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে পরিচিতি পান। সে সময়ই, ১৯৪০ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআই)’র সদস্য পদ লাভ করেন তিনি। এরপর চাকরিতে আসে আরো বেশি মনযোগ। ১৯৪১-৪২ সালে জসিম মণ্ডল প্রমোশন পেয়ে সেকেন্ড ফায়ারম্যান হন। এসময় রেল শ্রমিক আন্দোলনে তিনি জ্যোতি বসুর সহকর্মি ছিলেন। ১৯৪৬ এর নির্বাচনে রেল আসনে জ্যোতিবসু’র নির্বাচনী প্রচারনায় সক্রিয় অংশ নেন তিনি।

১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর জসিম মণ্ডল পার্বতীপুর এবং তার বাবা ঈশ্বরদীতে বদলি হয়ে আসেন। ১৯৪৯ সালে রেলের রেশনে চাউলের পরিবর্তে খুদ (চালের কুড়া) সরবরাহ করলে রেল শ্রমিক ইউনিয়নের ‘খুদ স্টাইকের’ অপরাধে জসিম উদ্দিন মণ্ডলসহ ছয় নেতার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয়। এক পর্যায়ে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে এবং রেল কর্তৃপক্ষ তাকে চাকুরিচ্যুত করে। সেখান থেকে ১৯৫৪ সালে তিনি মুক্তি পান। তবে কিছুদিন পর আবার তাকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হয়। এসময় রাজশাহী জেলে কিছুদিন থাকার পর তাকে বদলি করা হয় ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে।

সেন্ট্রাল জেল থেকে ১৯৫৬ সালে তিনি মুক্তি লাভ করেন গণমানুষের মুক্তির আন্দোলনে এই পুরোধা। ১৯৬২ সালের দিকে আবার গ্রেফতার হন এবং ১৯৬৪ সালে মুক্তি পান। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি কলকাতা চলে যান। সেখানে বাংলাদেশের মুক্তির জন্য পালন করেন অগ্রণী ভূমিকা। কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের সার্বিক মুক্তির লড়াই-সংগ্রামের জন্য স্বাধীন বাংলাদেশেও তাকে জেল বরণ করতে হয়েছে বহুবার। যার হিসেব করলে দেখা যায় সারা জীবনে তিনি প্রায় ১৭ বছর কারারুদ্ধ ছিলেন।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে, ৫১ বছর বয়সে জসিম মণ্ডল সংগঠক এবং উদ্দীপক হিসেবে ব্যাপক ভুমিকা রাখেন। ১৯৭৩ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভ্রমণ করেন। ১৯৯৩ সালে সিপিবি’র প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত হন। আর ২০১২ সালে মনোনীত হন সিপিবি’র উপদেষ্টা হিসেবে। আমৃত্যু এ দায়িত্বই তিনি পালন করে গেছেন।

কমরেড জসিম মণ্ডল বাংলাদেশ রেল শ্রমিক ইউনিয়ন ও বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সহ-সভাপতি ছিলেন দীর্ঘদিন। ছিলেন বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের উপদেষ্টা। ১৯৪২ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া এ কমরেডের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সহধর্মিনী জাহানারা খাতুন মরিয়ম উৎসাহ জুগিয়েছেন সারাজীবন। ভালোবাসার সংসারে জসিম-জাহানারা দম্পতি ছিলেন পাঁচ কন্যা ও এক পুত্রের জনক-জননী। আর অনিলবর্ষী এ বক্তা ৯৫ বছর বয়সে ২০১৭ সালের ২ অক্টোবর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ঢাকার হেলথ এন্ড হোপ হাসপাতালে।

মানুষ যে তার কর্মের মধ্য দিয়ে অম্লান হয়ে থাকে, তার অনন্য এক উদাহরণ হয়ে থাকবেন কমরেড জসীম উদ্দিন মন্ডল। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদী বিপ্লবী এ মানুষটি সবসময়ই চাইতেন মানুষকে ভালো রাখতে। তাইতো এখনো মানুষ ভালোবাসা মানুষগুলো তার অভাবটুকু বার বার উপলব্ধি করে। কান পেতে শোনে বার বার উচ্চারিত তার কালজয়ী বক্তব্য, 'এই পঁচা গলা সমাজটাকে ভাঙ্গতেই হবে, সুন্দর করে একটা নতুন সমাজ গড়তেই হবে। '

বাংলাদেশ সময়: ০৮১৬ ঘণ্টা; অক্টোবর ০২, ২০১৮
এইচএমএস/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।