ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

১ম পর্ব

পিরের গাঁওয়ের খোঁজে জোনাকপোকাদের অভিযাত্রা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০১৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২১, ২০১৮
পিরের গাঁওয়ের খোঁজে জোনাকপোকাদের অভিযাত্রা মাঠে গরু চরাতে নিয়ে যাচ্ছে এক রাখাল। ছবি: বাংলানিউজ

গ্র্যাজুয়েশন শেষে চাকরির পেছনে ছুটতে গিয়ে দিনকে দিন হতাশায় ডুবে যাচ্ছিলাম আমরা ক’জন। স্বাধীনভাবে নিজের পছন্দমতো কিছু একটা করার স্বপ্ন দেখে ফেলেছিলাম একবার। কিন্তু এক্ষেত্রে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, অর্থনৈতিক চাহিদা, ইতিহাস, লিঙ্গ, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বরাবরই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

যেন ভালো একটা চাকরি করতে পারি, সেটাই ছিল পরিবারের একমাত্র প্রত্যাশা। সমাজ-রাষ্ট্র-রাজনীতির কথা চিন্তা করলে এটাই একজনের জন্য আদর্শ অপশন।

এদিকে পড়ালেখায় একেবারেই মনোযোগী না থাকলেও ভালো কিছু ডিগ্রিও বাগিয়ে নিয়েছি। ডিগ্রির সঙ্গে বেড়েছে জগতের প্রত্যাশাও। এরপরও স্বাধীনভাবে কিছু একটা করার স্বপ্ন একেবারে ছুড়ে ফেলতে পারিনি কখনও।

এমন সময়ে জানতে পারি, আমাদের রুহুল ভাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশনের পর গ্রামের দিকে একটা ফার্ম হাউজ খুলে চাষাবাদ শুরু করে দিয়েছেন। ব্যাপক এলাকাজুড়ে তার সেই ফার্ম হাউজ। তাতে রয়েছে বিশাল বিশাল সাইজের কয়েকটা পুকুর, সেগুলোতে ছাড়া হয়েছে পোনা, রয়েছে গোয়াল, সবজি বাগান, হাস-মুরগির খামার, ধানিজমি আরও কতো কি।  
সারিবদ্ধ হয়ে দক্ষতার সঙ্গে দ্রুত হাতে ধান কাটছে একদল কৃষক
চাকরিহীন অথবা দিনরাত গাধার মতো খেটে হতাশাজনক বেতনের অধিকারী ক’জন যুবককে ব্যাপকভাবে ইন্সপায়ার্ড করে ফেলে রুহুল ভাইয়ের ফার্ম হাউজ। এই জনবহুল দেশের খাদ্য চাহিদা পূরণ করতে তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে নিজেও চাষাবাদ শুরুর সম্ভাবনা নিয়ে হিসাব-নিকাশ কষি মাঝে মাঝে। একটা ব্যাপারে আমি নিশ্চিত, চাষাবাদে আমি ভালো করবো। স্কুলে কৃষিশিক্ষা বিষয়টা আমার বেশ পছন্দের ছিল, এতে আমি বরাবরই ভালো নম্বর পেতাম। এভাবে নিয়তি হয়তো আমাকে কৃষক হওয়ার ইঙ্গিতটা আগেই দিয়ে রেখেছিল। কিন্তু হায়, আমি সেটাকে তখন চিনতে পারিনি। যদিও এসব একটানা বেশিক্ষণ ভাবতে পারি না। বাধা দেয় পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, অর্থনৈতিক চাহিদা, ইতিহাস, লিঙ্গ, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।
এসব কারণেই হয়তো রুহুল ভাইয়ের ফার্ম হাউজে ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যানে শরিক হয়ে গেলাম। আমাদের আগে থেকেই দাওয়াত করে রেখেছিলেন রুহুল ভাই। নিজের ভবিষ্যতের মতোই এক কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের রাতে চারজন রওনা হলাম রুহুল ভাইয়ের ফার্ম হাউজের উদ্দেশ্যে।
যাওয়ার পথ সহজ ঠেকলো না। বাসে চড়ে ঢাকা থেকে সিলেট নির্ঝঞ্ঝাটেই পৌঁছালাম। সেখান থেকে ধরতে হবে জগন্নাথপুরের বাস। নামতে হবে শ্রীরামসী রাস্তার মুখে। এই ‘শ্রীরামসী’ নামটা থেকেই শুরু হলো বিভ্রান্তি। স্থানীয়রা ‘শ্রীরামসী’ নামটা যেভাবে উচ্চারণ করে তা লিখে প্রকাশ করা কষ্টকর। ‘সিরামিক’ এবং ‘সিরামিসি’ শব্দ দু’টোর মাঝামাঝি শোনায় উচ্চারণটা। ধরে নিলাম শব্দটা সম্ভবত ‘সিরামিক’ই হবে।
ধানের ওপর জমেছে ভোরের শিশির
এদিকে জগন্নাথপুরের বাসের ড্রাইভার, হেল্পার, কাউন্টারের লোকজন, যাত্রী প্রত্যেকে ‘সিরামিকের রাস্তা’ নামের কোনো জায়গা চিনতে ব্যর্থ। আরেক বিপদ এ অঞ্চলের মানুষের ভাষা, যা আমাদের চারজনেরই বোধগম্যতার বাইরে। জায়গার নামটা ঠিকমতো নিশ্চিত না হয়ে বাসে উঠতেও ভয়, কোথায় না কোথায় নামিয়ে দেয়।

পথের হদিসের খোঁজে চারপাশের মানুষজনকে ত্যক্ত-বিরক্ত করতে করতে যখন নিজেরাই হাঁপিয়ে উঠেছি, তখন এক মুরুব্বি এগিয়ে এলেন আমাদের উদ্ধার করতে। তিনি অনেক পরিশ্রম করে আমাদের বোঝাতে সক্ষম হলেন যে, আমরা যেখানে যেতে চাচ্ছি তিনি সেটা চিনেছেন এবং হেল্পারকে বলে দিয়েছেন আমাদের জায়গা মতো নামিয়ে দিতে। জায়গার নাম নিয়ে আর টেনশন করতে হচ্ছে না, এতেই আমরা খুশি।

সিলেট অঞ্চলের গ্রামগুলোতে একটা বিষয় খুব নজরে পড়লো। একদম অজ-পাড়াগাঁয়েও হঠাৎ হঠাৎ চোখে পড়ে বিলাসবহুল ধাঁচে গড়ে ওঠা বহুতল বাসভবন। গ্রামের ক্ষেত-খামার, খাল-বিলের মাঝ দিয়ে চলতে চলতে হঠাৎ করেই প্রাচীর ঘেরা এই ভবনগুলো চোখ পড়বে।  
সবগুলোতেই সাদা বা কোনো উজ্জ্বল রঙের ছোঁয়া, যাতে অনেক দূর থেকেও মানুষের চোখে পড়ে। তবে কাছে গেলে দেখা যায় এতে দরজা-জানালা কিছুই নেই, ইন্টেরিয়রেরও কোনো কাজ করা হয়নি। দেখে মনে হয়না কেউ কোনোদিন সেখানে থেকেছে। কেবল কাঠামোটা তুলে উজ্জ্বল রং মেখে ফেলে রাখা হয়েছে। আমি এগুলোর নাম দিলাম ‘কংকাল’ বাড়ি।
স্থানীয়দের মুখে জানা গেলো, এই অঞ্চলের লন্ডন প্রবাসীরাই এই ‘কংকালগুলো’ নির্মাণ করেছেন। ‘কংকালগুলোর’ বাইরের চাকচিক্য গ্রামের লোকজনদের কাছে নিজেকে বিত্তশালী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার এক ধরনের প্রয়াস। তবে নিজেরা কখনও এতে থাকার প্রয়োজনবোধ করেননি বলে ইন্টেরিয়র নিয়ে তারা মাথা ঘামাননি।
ধান
গ্রাম, হাট-বাজার, ফসলি জমি আর অসংখ্য ‘কংকাল’ দেখতে দেখতে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছে যাই শ্রীরামসী রাস্তার মুখ। এখান থেকে ইজিবাইকে করে যেতে হবে আরও কয়েক কিলো। তবে ইজিবাইকেও পৌঁছানো যাবে না ফার্ম হাউজে। আরও খানিকটা পথ হেঁটে পৌছাতে হবে পিরের গাঁও। এই পিরের গাঁও নামের গ্রামেই রুহুল ভাইয়ের ফার্ম হাউজ।
পদব্রজে চলবার সময় টের পেলাম, ফা-হিয়েনরা এই বাঙাল মুল্লুকে এসে কতো কষ্টই না করেছেন। হেঁটে ঘুরে বেড়িয়েছেন গ্রামের পর গ্রাম। এদিকে একটা মাত্র গ্রাম হেঁটে পার হতে গিয়ে আমাদের পা অবশ হয়ে আসছিল, কোমর টন টন করতে লাগলো, কাঁধে ঝোলানো ব্যাকপ্যাক ক্রমেই ভারি হয়ে উঠতে লাগলো। ফার্ম হাউজে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সবাই সিদ্ধান্ত নিলাম ঢাকা ফিরে প্রতিদিন সকালে উঠে জগিংটা শুরু করতেই হবে। ঢাকার বিষাক্ত বাতাসে বেড়ে ওঠা এই শরীর নিয়ে বেঁচে থাকা না থাকারই সমান।

রুহুল ভাইয়ের ফার্ম হাউজটা স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না এমন অজ-পাড়া গাঁয়েও এরকম একটা উদ্যোগ গড়ে তোলা যায়। প্রায় সতের বিঘা প্রাচীরঘেরা জমির ওপর ফার্ম হাউজটা। মাঝখানে একটা বাড়ি। এই বাড়ির একটা রুমে থাকেন রুহুল ভাই এবং তার সহযোগী তামিম ভাই। এর ভেতরেই রয়েছে চারটা পুকুর। দু’টো পুকুরে মাছ চাষ হচ্ছে। একটা অংশে লাগানো হয়েছে বিভিন্ন জাতের গাছ। জায়গায় জায়গায় মনের আনন্দে ঘাস-লতাপাতা খেয়ে চলেছে বাংলাদেশের গর্ব ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল। হাঁস-মুরগিও আছে, তবে স্বল্প পরিসরে।

ফার্ম হাউজের পেছনেই দিগন্ত জোড়া ফসলের মাঠ। এই মৌসুমে যতো দূর চোখ যাবে কেবলই সোনালি রঙের ছড়াছড়ি। ঘরে ঘরে সোনার ফসল নিয়ে ফিরছেন কৃষকরা। এই মাঠের কিছু জমিতে রুহুল ভাইও ধান ফলিয়েছেন। ধান মাড়াইয়ের মেশিনও আছে তার নিজের। কেটে আনা ধান মেশিনে প্রসেসিংয়ের পর চলে যায় বাড়ির সঙ্গেই লাগোয়া গোডাউনে। এই যুগের বাংলাদেশে রুহুল ভাইয়ের ফার্ম হাউজটাকে রীতিমতো জমিদারিই বলা চলে। আর পুরোটাই তামিম ভাইয়ের সহযোগিতায় তদারকি করেন রুহুল ভাই নিজে।
রুহুল ভাইয়ের ফার্ম হাউজের বিভিন্ন অংশ
ফার্ম হাউজে পৌঁছাতে পৌঁছাতে তখন বিকেল। রুহুল ভাই আর তামিম ভাইয়ের আন্তরিক আপ্যায়নের ফলে নিমিষেই ভুলে গেলাম দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তি। রুহুল ভাই বলে দিলেন, যতদিন ইচ্ছে হয় থেকে যেতে। এই দুই অমায়িক ব্যক্তির ছোট্ট সংসারের সঙ্গে নিমিষেই যেন মিশে গেলাম আমরা। দেখলাম গবাদি পশু ও হাঁসমুরগিদের সঙ্গে গড়ে ওঠা তাদের বন্ধুত্ব। দেখলাম চারা থেকে বৃক্ষে রূপ নিতে চলা বিভিন্ন জাতের গাছেদের প্রতি রুহুল ভাইয়ের অপত্যস্নেহ। চোখ এড়ায় না পুকুর পাড়ে অপরিকল্পিতভাবে জন্মানো গাছে বেড়ে উঠতে থাকা কচি লাউগুলোর প্রতি তামিম ভাইয়ের গোপন মমত্বটুকুও।
রান্না সংক্রান্ত কাজগুলো সামাল দেন তামিম ভাই। তার এই গুণটি আমাদের মুগ্ধ করেছে প্রতিবেলা। ভাতের সঙ্গে কেবল সবজির এক প্রকার ঘ্যাঁট আর পাতলা ডাল যে লাঞ্চ বা ডিনার হিসেবে কখনও এতো সুস্বাদু হওয়া সম্ভব, তা তামিম ভাইয়ের রান্না না খেলে বিশ্বাস হবে না। গ্রামের এদিক সেদিক ঘুরাঘুরি করে, ছিপ দিয়ে মাছ ধরে কাটালাম দিনগুলো। আর সন্ধ্যার পর শুরু হতো ডমিনোস টুর্নামেন্ট, আড্ডা, ভূতের গল্প আর ডিনারের পর সিগারেট খাওয়ার নাম করে গ্রামের অন্ধকার নির্জন গা ছমছমে পরিবেশে ভূত দেখার আশায় এদিক-সেদিক হাঁটাহাঁটি। ভাগ্যে ভূতের দেখা না মিললেও দেখেছি আদিগন্ত সোনালি সমুদ্রে দুলতে থাকা ধানের সারি। তবে সোনালি সমুদ্রের গল্পটি পাঠকের জন্য তোলা থাকল পরের পর্বে।

বাংলাদেশ সময়: ০৫১৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২১, ২০১৮
এনএইচটি/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।