ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

ফিচার

দেশের সবচে বড় ঈদের জামাত

মুনিরুজ্জামান খান চৌধুরী সোহেল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০১৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৪, ২০১০
দেশের সবচে বড় ঈদের জামাত

কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ঈদুল ফিতরের জামাত। এ জামাতে তিন লক্ষাধিক মুসুল্লি একসাথে নামাজ আদায় করেন।

শোলাকিয়া মাঠের জামাতের প্রতি মুসুল্লিদের আকর্ষণ ক্রমেই বাড়ছে। ফলে প্রতি বছরই জামাতের কলেবর বৃদ্ধি পাচ্ছে, এর সাথে ছড়িয়ে পড়ছে মাঠের সুনাম।

শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানের এ বিশাল জামাত একই সাথে গৌরবান্বিত ও ঐতিহ্যশালী করেছে কিশোরগঞ্জকে। তবে এতো সুনাম ও ঐতিহ্য সত্ত্বেও এর অবকাঠামোগত উন্নয়ন চোখে পড়ার মতো নয়। ময়দানটিকে ঘিরে রয়েছে অনুচ্চ প্রাচীর। সাধারণ মেহরাব এবং একটি তোরণ ছাড়া এখানে তেমন কোনো স্থাপত্য সৌন্দর্য নেই। মুসুল্লিরা মাটিতেই নামাজ পড়ে থাকেন। ফলে বৃষ্টি হলে সৃষ্ট কর্দমাক্ত মাঠে মুসুলল্লিরা বিপাকে পড়েন।

ঈদ জামাত: প্রতি বছর পহেলা শাওয়াল ও ১০ জিলহজ যথাক্রমে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার জামাত অনুষ্ঠিত হয় এখানে। শোলাকিয়া ঈদগাহের জামাত শুধু দেশের নয়, উপমহাদেশেরও বৃহত্তম ঈদ জামাত হিসেবে বিবেচিত। হারমাঈন শরীফাঈনের পর শোলাকিয়া ঈদগাহে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম জামায়াত অনুষ্ঠিত হয়।

অবস্থান ও আয়তন: শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠের অবস্থান কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের পূর্বপ্রান্তে নরসুন্দা নদীর তীরে। মসনদ-ঈ-আলা ঈশা খাঁর ষষ্ঠ বংশধর দেওয়ান হয়বত খানের উত্তরসূরি দেওয়ান মান্নান দাদ খান ১৯৫০ সালে ৪.৩৫ একর ভূমি শোলাকিয়া ঈদগাহকে ওয়াকফ করে দেন। এ মাঠের বর্তমান জমির পরিমাণ হয়েছে ৬.৬১ একর। অবশ্য অজু করার পুকুর, মাঠ ও অন্যান্য মিলিয়ে মাঠের মোট পরিমাণ প্রায় ৭ একর। মাঠে প্রবেশের মূল সড়কে একটি তোরণ ও একটি দোতলা মিম্বর রয়েছে।

নামকরণ: শোলাকিয়া কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের একটি বৃহৎ ও পুরাতন জনবসতি এলাকা। বর্তমান শোলাকিয়ার পূর্বনাম ছিল রাজাবাড়িয়া। কিশোরগঞ্জ শহরের পূর্ব-উত্তর কোণে নরসুন্দা নদীর অববাহিকায় শোলাকিয়া এলাকাটির অবস্থান। জনশ্রুতি আছে, শোলাকিয়া ঈদগাহের প্রথম বড় জামায়াতে সোয়া লাখ মুসুল্লি অংশ নিয়েছিলেন। অন্য মতে, মোগল আমলে এখানে অবস্থিত পরগনার রাজস্বের পরিমাণ ছিল সোয়া লাখ টাকা। উচ্চারণের বিবর্তনে সোয়া লাখ থেকে সোয়ালাখিয়া, সেখান থেকে বর্তমান নাম শোলাকিয়া।

ইতিহাস: দেওয়ান মান্নান দাদ খান যে জমি ১৯৫০ সালে ওয়াকফ করেছেন, সে ওয়াকফ নামায় ১৭৫০  সাল থেকে এ মাঠে ঈদের জামাত হয়ে আসছে বলে লেখা আছে। সে হিসেবে মাঠের বর্তমান বয়স ২৬১ বছর। জানা যায়, ১৮২৮ থেকে জঙ্গলবাড়ির জমিদার এ মাঠে নামাজ পড়তে শুরু করেন। তখন থেকে বড় জামাত শুরু হয়। সে হিসেবে আগামী ১ শাওয়াল শোলাকিয়া ঈদগাহে ঈদুল ফিতরের ১৮৩তম বড় জামাত অনুষ্ঠিত হবে।

ঈদগাহ পরিচালনা: ১৯৫০ সাল থেকে ওয়াকফের দলিলমূলে হয়বতনগর জমিদারবাড়ির দেওয়ান মান্নান দাদ খান থেকে বংশানুক্রমিক জ্যেষ্ঠ পুত্ররা শোলাকিয়া ঈদগাহের মোতাওয়াল্লির দায়িত্ব পালন করে আসছেন। বর্তমানে দেওয়ান ফাত্তাহ দাদ খান মঈন মোতাওয়াল্লী ও দেওয়ান মোঃ রউফ দাদ খান নায়েবে মোতাওয়াল্লির দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে একটি কমিটি মাঠ পরিচালনা করে।

ঈদগাহের ইমাম: ১৮২৮ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম বড় জামায়াতের ইমামতি করেন সুফি সৈয়দ আহমদ। বরকতময় শোলাকিয়া ঈদগাহে যুগে যুগে খ্যাতনামা আলেমগণ ইমামের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এবার ইমামতি করবেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম (একাংশের) মহাসচিব মাওলানা মোঃ ফরিদ উদ্দিন মাসউদ।

মুসল্লি ও মেলা: ২৬৫টি কাতার সম্বলিত শোলাকিয়া ঈদগাহে প্রতি বছর লাখ লাখ মুসুল্লির সমাবেশ ঘটে। ঈদের নামাজ মাঠে পড়া সুন্নতে মোয়াক্কাদা এবং যে জামায়াতে মুসুল্লি যত বেশি হয় ছওয়াবও তত বেশি হয় ও গোনাহ মাফ হয়--- এ বিশ্বাস থেকেই ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা নামাজ পড়তে আসেন। পবিত্র ঈদুল ফিতরের এ বিশাল জামায়াতে জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের অসংখ্য মুসুল্লির সাথে সাথে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে হাজার হাজার মুসলমান নামাজে অংশ নেন। জামাত শুরুর মুহূর্তে মাঠের অনুচ্চ প্রাচীরের বাহিরের সড়ক, নদীর পাড় এবং আশপাশ এলাকায় মুসুল্লিদের কাতার ছড়িয়ে পড়ে।

জামাতের সাথে সাথে ময়দানের পশ্চিম দিকে বসা ঈদমেলাটিও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মেলায় বেতের সুন্নতি লাঠি, বিভিন্ন গৃহস্থালি সামগ্রির সাজানো পসরা মুসুল্লিদের আকৃষ্ট করে থাকে।

সম্প্রচার: প্রথমবারের মতো ২০০৬ সালে এনটিভি সরাসরি সম্প্রচার করে এ বড় জামাতের। এরপর থেকে প্রতিবারই চ্যানেল আই সরাসরি সম্প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। এবারও চ্যানেল আই সরাসরি সম্প্রচার করবে। এছাড়া অন্যান্য মিডিয়াগুলোর নজর থাকে শোলাকিয়া ময়দানের দিকে।

সময় ঘোষণা: ঈদের জামাত শুরু হওয়ার ৫ মিনিট আগে ৩টি, ৩ মিনিট আগে ২টি এবং ১ মিনিট আগে ১টি শটগানের গুলি ফুটিয়ে আওয়াজ করা হয় দীর্ঘদিনের রেওয়াজ অনুযায়ী। সকাল ১০টায় জামায়াত অনুষ্ঠিত হয়।

ঈদগাহের সমস্যা, উন্নয়ন ও প্রস্তাব: আড়াই শত বছরের পুরনো শোলাকিয়া ঈদগাহটি ঐতিহ্যের তুলনায় উন্নয়ন ও সংস্কারের ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছে। কিশোরগঞ্জের সুশীল সমাজ ঈদগাহের সামনের পৌরসভার নিয়ন্ত্রণাধীন গরুর হাটটি মাঠের অনুকূলে ব্যবহার ও বরাদ্দের দাবি জানিয়ে আসছেন। কমিটির কার্যক্রম শুধু ঈদকেন্দ্রিক হওয়ায় সারা বছর কোনো কাজ হয় না। শোলাকিয়া ঈদগাহকে শোলাকিয়া আন্তর্জাতিক ঈদগাহ নামকরণ এবং মুসুল্লিদের সুবিধার্থে মাঠের পরিসর বৃদ্ধিসহ উন্নয়নের দাবি দীর্ঘ দিনের।

বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ঈদুল ফিতরের জামাত শোলাকিয়া ঈদগাহে অনুষ্ঠানের ফলে এটি ঐতিহাসিক স্থানে পরিণত হয়েছে। ফলে এর গুরুত্ব বেড়ে গেছে বহুগুণ। তাই সবার দৃষ্টি আজও ময়দানের দিকে। এ কারণে সময়ের দাবি শোলাকিয়া ময়দানকে আরো আকর্ষণীয় ও উপযোগী করে তোলার।

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ০০১৫, সেপ্টেম্বর ০৩, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।