ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

শিশুদের জন্য মায়ের ‘আঁচল’

ইসমাইল হোসেন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৯
শিশুদের জন্য মায়ের ‘আঁচল’

মনোহরদী, নরসিংদী থেকে ফিরে: স্কুলে যাওয়া-আসা শুরুর আগে এক থেকে চার পাঁচ বছরের শিশুরা পারিবারিক আবহেই বড় হতে থাকে। কিন্তু বাবা-মায়েদের কাজের ফাঁকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেই শিশু হঠাৎ করেই পড়ে যায় দুর্ঘটনায়। আগুন, পানি কিংবা অন্য কোনো দুর্ঘটনা; যে কারণে ওই শিশুর জীবন হানি পর্যন্ত ঘটে।

পরিসংখ্যান বলছে, সারাদেশে বছরে এক থেকে চার বছর বয়সী অন্তত ১০ হাজার শিশুর মৃত্যু হয় পানিতে ডুবে। এই হিসাবে প্রতিদিন প্রাণ যায় প্রায় ৩০ শিশুর; যা হিসাব করলে একটি শ্রেণিকক্ষের মোট শিশু-শিক্ষার্থীর সমান!

পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু হওয়া রোধে বেসরকারিভাবে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও সরকারিভাবে তেমন উদ্যোগ নেই।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্কুল যাওয়ার আগের বয়সী শিশুদের নিবিড় তত্ত্বাবধান, স্কুলগামী শিশুদের সাঁতার শেখানোর উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
 
শিশুরা খেলছে আর সময় কাটাচ্ছে আপন মনে।                                          ছবি: বাংলানিউজস্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) পরিচালিত ‘বাংলাদেশ হেলথ অ্যান্ড ইনজুরি সার্ভে ২০১৬’র তথ্যানুযায়ী, দেশে প্রতিদিন পানিতে ডুবে মারা যায় অন্তত ৩০ শিশু।

পানিতে ডুবে শিশুদের মৃত্যু হওয়া রোধে সিরাজগঞ্জ এবং নরসিংদী জেলায় ‘আঁচল’ নামে শিশু সেবাকেন্দ্র চালু করেছে সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি)।

সম্প্রতি নরসিংদী জেলার মনোহরদীতে গিয়ে দেখা যায় এসব কেন্দ্রে মায়ের যত্নে বেড়ে উঠছে এক থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশু। প্রতিকেন্দ্রে ২৫ জন করে শিশু বেড়ে উঠছে।
 
উপজেলার লেবুতলা ইউনিয়নের নরেন্দ্রপুর গ্রামের ‘আঁচল’ (০৪)-এ শিশুরা কবিতা, ছড়া, সঙ্গীতের মাধ্যমে সময় পার করছে। একজন ‘আঁচল মা’ তাদের দুর্ঘটনা রোধে করণীয় ছাড়াও মনোদৈহিক বিকাশের পথ বাতলে দিচ্ছেন।

‘আঁচল মা’ আকলিমা বেগম বাংলানিউজকে বলেন, সকাল ৯টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত বাচ্চাদের দুর্ঘটনার সময়। এই সময়ে এখানে থাকলে শিশুরা দুর্ঘটনা থেকে মুক্ত থাকে।

২০১৩ সালের ডিসেম্বর থেকে আকলিমা ‘আঁচল মা’ হিসেবে কাজ করছেন জানিয়ে বলেন, ৯ মাস থেকে ৫৯ মাস বয়স পর্যন্ত বাচ্চারা এখানে আসে। টাকা-পয়সা কতটুকু পাই সেটা বড় কথা না, শিশুদের সঙ্গে সময় কাটাই, এটাই বড় কথা।

দুই বছর বয়সী ছেলেকে এখানে রাখাটা নিরাপদ মনে করেন স্থানীয় মা রেখা। তার এক মেয়ে আঁচলে থেকে এখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে ভালো ফল করছে দাবি করে বলেন, এখানে রাখলে আগুনে পোড়া, কাটা যাওয়া, পানিতে পড়ার মতো ইনজুরি থেকে বাঁচে এবং আমি বাড়ির কাজগুলো ভালোভাবে করতে পারি।

মনোহরদী সরকারি কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ওবায়দুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বাচ্চারা দুর্ঘটনায় পড়ে। এই সময় আঁচলে রাখলে তারা নিরাপদে থাকে। এখানে বিভিন্ন অক্ষর, ছড়া সুন্দরভাবে শেখায়। সারাদেশে সরকারিভাবে ‘আঁচল’র পরিসর বাড়ানো উচিত।

পাশের মিন্দাবাড়ি গ্রামের ‘আঁচল’ (০৬) কেন্দ্রেও দেখা যায় শিশুদের উচ্ছ্বসিত উপস্থিতি। এখানে এক শিশুর মা রুনা বাংলানিউজকে বলেন, তিন বছর বয়সী মেয়েকে দু’বছর আগে এখানে দিয়েছি। লেখাপড়া শেখানো ছাড়াও শিশুরা যাতে আগুন কিংবা পানিতে না পড়ে এবং সুন্দর-শৃঙ্খলভাবে থাকে, সেই বিষয়গুলো খেয়াল রাখে আঁচলে।  

স্থানীয় বাসিন্দা মনিরুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, এ ধরনের স্কুলে (আঁচল) বাচ্চারা নিরাপদে থাকে। এখানে বাচ্চাদের রেখে নিশ্চিন্তে অন্য কাজকর্ম করতে পারছে অভিভাবকরা। এখানে বাচ্চারা ঘরের ভেতরে নিরাপদে থাকে।

মনোহরদীর হাফিজপুর গ্রামের শফিকুল ইসলাম ও খাদিজা বেগম দম্পতির ১৮ বছর বয়সী প্রথম সন্তান সামিম ইসলাম সানি চলতি বছরের মে মাসে বাড়ির পাশের ডোবায় পড়ে মারা যায়। খাদিজা বাংলানিউজকে বলেন, আমি কাজে ব্যস্ত থাকায় আমার ছেলে পানিতে ডুবে যায়।
 
সিআইপিআরবি’র মনোহরদী উপজেলা কো-অর্ডিনেটর এএনএম মঈদুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে নয়টিতে ৫৬৬টি ‘আঁচল’ চালু করা হয়। বর্তমানে ৪৬১টি রয়েছে। কিছু বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণ শিশু এবং ‘আঁচল মা’ না পাওয়া।
 
তিনি বলেন, এখানে নিরাপদে থাকা ছাড়াও শিশুরা পড়ালেখা এবং সামাজিকতার বিষয়গুলো শিখছে। ফলে দুর্ঘটনা রোধ করা যাচ্ছে।
 
মনোহরদীতে গত এক বছরে সাতটি শিশু মারা গেছে, যার মধ্যে আঁচলের দু’টি। তারা আঁচল সময়ের (সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা) বাইরে পানিতে ডুবে মারা যায় বলে জানান মঈদুল।
 
অসচেতনতায় পানিতে ডুবে শিশুদের মৃত্যু হয় জানিয়ে সিআইপিআরবি’র প্রজেক্ট ম্যানেজার ডা. মো. আল-আমিন ভূঁইয়া বাংলানিউজকে বলেন, যারা মারা যাচ্ছে তাদের তথ্যও সংরক্ষণ করা হচ্ছে না। ফলে এটি অগোচরেই রয়ে যায়। সরকার ‘আঁচল’র পাশে থাকলে আরও ভালো হবে।

ইন্টারন্যাশনাল ড্রাউনিং রিসার্স সেন্টার, বাংলাদেশের (আইডিআরসি-বি) পরিচালক আমিনুর রহমান বলেন, পানিতে ডুবে শিশুদের মৃত্যু হওয়া কমাতে বর্তমানে বেসরকারি উদ্যোগে কিছু উপজেলায় কাজ করা হলেও সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ না নিলে এটি বৃহৎ আকারে করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য এবং নারী ও শিশু মন্ত্রণালয় কাজ করতে পারে। এজন্য প্রয়োজন জাতীয় নীতিমালা।
 
তিনি বলেন, চার থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত বাচ্চারা আঁচলের মতো কেন্দ্রে থাকলেও যাদের বয়স পাঁচ থেকে ১১, তাদের সাঁতার শেখাতে হবে। পানিতে ডুবে গেলে কী করণীয় সেটিও শিক্ষা দিতে হবে। এজন্য জনসচেতা বাড়াতে হবে।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৪৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৯
এমআইএইচ/এসএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।